Advertisement
E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: স্বাধিকারের ইতিহাস

‘যাদবপুর স্বশাসিত, তাই মন্তব্য নয়— পার্থ’ শীর্ষক সংবাদের (১৮-৭) পরিপ্রেক্ষিতে এই চিঠি। শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, “যাদবপুর স্বশাসিত অঞ্চল, স্বশাসিতই থাকুক। আমার মন্তব্য করার কোনও দরকার নেই।”

শেষ আপডেট: ০১ অগস্ট ২০১৮ ০০:০১

‘যাদবপুর স্বশাসিত, তাই মন্তব্য নয়— পার্থ’ শীর্ষক সংবাদের (১৮-৭) পরিপ্রেক্ষিতে এই চিঠি। শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, “যাদবপুর স্বশাসিত অঞ্চল, স্বশাসিতই থাকুক। আমার মন্তব্য করার কোনও দরকার নেই।” স্বশাসিত অঞ্চল বলতে তিনি এখানে কী বোঝাতে চাইলেন? কোনও দেশে একটা বিশ্ববিদ্যালয় স্বশাসিত ‘অঞ্চল’ হয় কী করে? আমরা জানি ভারতে অনেকগুলো স্বশাসিত প্রশাসনিক বিভাগ আছে, যেখানে কেন্দ্রীয় সরকার নানা মাত্রার স্বশাসনের ক্ষমতা দিয়েছে। এগুলো যেমন জম্মু-কাশ্মীরে আছে, তেমনই আছে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিল অনুযায়ী উত্তর-পূর্ব ভারতের কিছু রাজ্যে। এ রাজ্যের দার্জিলিং পাহাড়ের জিটিএ তেমনই স্বশাসিত প্রশাসনিক অঞ্চল। এখানে কেন্দ্র বা সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকার নির্দিষ্ট কিছু প্রশাসনিক ক্ষেত্রে কোনও হস্তক্ষেপ করে না। কিন্তু এ সবের সঙ্গে যাদবপুরের মতো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক কোথায়? তিনি কি আঞ্চলিক স্বশাসনের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় তথা শিক্ষার স্বাধিকার গুলিয়ে ফেললেন?

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাধিকারের প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, শিক্ষার স্বাধিকারের ধারণার সঙ্গে যুক্ত আছে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনার বিষয়টি। এই ধারণার জন্ম এক দিনে হয়নি। ইতিহাসে দেখা যাবে অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, বার্লিন বা প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়— যাদের খ্যাতি আজ বিশ্বজোড়া— তাদের স্থাপনা হয়েছিল দশম-একাদশ শতকে, ইউরোপে যখন মধ্যযুগ। চার্চের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় সৃষ্ট এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলি চালানোর অর্থের জোগান দিত রাজা ও চার্চ। পঠন-পাঠনের বিষয়বস্তু নির্ধারিত হত চার্চ বা ধর্মগুরুদের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে ও অঙ্গুলিহেলনে। পড়ানো হত বাইবেল ও অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ এবং অ্যারিস্টটল, প্লেটো বা টলেমির লেখা।

পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে রেনেসাঁস সূচনার আবহে বিজ্ঞানের যে জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল, তার পরেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলির এমন ভূমিকা অপরিবর্তিত ছিল। পরিবর্তন শুরু হল শিল্প বিপ্লব ও রেনেসাঁস আন্দোলনের ফলে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর। শিক্ষার আর্থিক দায়িত্ব যে হেতু নির্বাচিত সরকার তথা জনগণের উপর বর্তাল, তখন থেকেই দাবি উঠেছিল মধ্যযুগীয় শিক্ষার পরিবর্তে উন্নত ও বৈজ্ঞানিক শিক্ষার।

দাবি উঠেছিল, শিক্ষার পঠনপাঠন, গবেষণা, ডিগ্রি, মূল্যায়ন প্রভৃতি শিক্ষা পরিচালনার সামগ্রিক বিষয়টি দেখবহালের দায়িত্বে থাকবেন শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত শিক্ষক-শিক্ষাবিদ-গবেষক-ছাত্রদের নিয়ে গঠিত সংস্থা। অর্থাৎ, শিক্ষা প্রদানের আর্থিক দায়িত্ব সরকারের, কিন্তু পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন শিক্ষক-শিক্ষাবিদরাই। আবার আর্থিক দায়িত্ব বহনের অজুহাতে ‘কী পড়বে, কে পড়াবে এবং কাকে পড়ানো হবে’ প্রভৃতি নির্ধারণে হস্তক্ষেপ করার অধিকার সরকার বা শাসক দলের জন্মাবে না। এটাই হল সংক্ষেপে শিক্ষা পরিচালনায় স্বাধিকার তথা গণতন্ত্রের ধারণা।

এক দিনে এমন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হয়নি। এর জন্য নবজাগরণ আন্দোলনের মনীষীদের ইউরোপে যেমন লড়তে হয়েছে, এ দেশেও লড়তে হয়েছে। বিদেশি শাসনের যুগে বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, স্যর আশুতোষরা এর জন্য লড়াই করেছিলেন। সংস্কৃত কলেজে আধুনিক শিক্ষা প্রচলনের জন্য কলেজের সহকারী সম্পাদক হিসাবে ১৮৪৬ সালে বিদ্যাসাগর একটি বিস্তারিত প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। কিন্তু বার বার অনুরোধ সত্ত্বেও তা কলেজ কর্তৃপক্ষ কাউন্সিল অব এডুকেশনে পাঠাননি। ফলে উচ্চ বেতনের ওই পদ বিদ্যাসাগর ছেড়ে দিতে দ্বিতীয় বার ভাবেননি। কলেজের সম্পাদক বলেছিলেন, চাকরি ছেড়ে দিলে বিদ্যাসাগর খাবে কী? শুনে বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, ‘‘বিদ্যাসাগর আলু-পটল বেচে খাবে, মুদির দোকান করে খাবে, কিন্তু যে চাকরিতে সম্মান নেই সে চাকরি করবে না।’’

কেবল মন্ত্রীরা নন, উপাচার্যের মতো পদে যাঁরা আসীন হচ্ছেন তাঁরা যদি এই ইতিহাস থেকে কোনও শিক্ষা নেন, তা হলে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মঙ্গল।

তরুণকান্তি নস্কর, শিক্ষক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়

‘মান রাখতেই লটারি রদের ভাবনা: পার্থ’ (২৪-৭) কিংবা ‘পাশ-ফেল ফিরবে কি, কমিটি রাজ্যের’ (২০-৭)শীর্ষক খবরগুলিতে প্রকাশ, বিদ্যালয়গুলিতে ‘পাশ-ফেল’ প্রথা আবার চালু হতে চলেছে। প্রাথমিক শিক্ষার উন্নতির জন্য ১৯৮৬ সালে রাজীব গাঁধীর আমলে ভারত সরকার ‘চ্যালেঞ্জ অব এডুকেশন’ এবং ‘অপারেশন ব্ল্যাকবোর্ড’ পরিকল্পনা নিয়েছিল। তার পরে এসেছে ‘সকলের জন্য শিক্ষা আইন’। সমাজের দিক থেকেও শিক্ষার চাহিদা বেড়েছে। তার নানা সুফলও ফলেছে। ৪২ বছর গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসাবে কাজ করার সুবাদে দেখেছি, সব মা-বাবাই নিজের সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করতে চান। তাঁরা চান লেখাপড়া শিখে চাকরি করে সন্তানেরা সুখে থাকবে এবং মা-বাপকেও সুখে রাখবে।

গত সত্তরের দশকে দেখেছি, প্রথম শ্রেণিতে ১০০ জন ছাত্রছাত্রী থাকলে, দ্বিতীয় শ্রেণিতে থাকে মাত্র ১৫ বা ২০ জন। শতকরা ৮০ থেকে ৮৫ জন প্রথম থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ওঠার আগেই শুকিয়ে যেত। তারা অধিকাংশই জনজাতি বা দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের সন্তান। ভাষাবিভ্রাটের ফলে যারা শুরু থেকেই পিছিয়ে পড়ত। এখন এ চিত্রের কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। স্কুলের সংখ্যা বেড়েছে, পরিকাঠামোর কিছুটা উন্নতি হয়েছে। শিক্ষক সংখ্যা বেড়েছে। আরও বাড়তে চলেছে। বইপত্র স্কুল থেকেই মোটামুটি সময় মতো দেওয়া হয়। দুপুরবেলায় পেট ভরে খাবার দেওয়া হয়।

কিন্তু একই সঙ্গে মানতেই হবে, ‘সকলের জন্য শিক্ষা’ অনেকের নাগালের বাইরেই রয়ে গেল। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া ছাত্রছাত্রীদের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ অক্ষরজ্ঞানহীনই রয়ে গেল। প্রকৃতপক্ষে শিক্ষা ক্ষেত্রে পরীক্ষা বা মূল্যায়ন ব্যবস্থা শিক্ষাকে সঙ্কুচিত করতে করতে হত্যা করেছে। আধুনিক যুগে পাশ-ফেল প্রথার কোনও প্রাসঙ্গিকতা নেই।

শিক্ষা সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গিটা পাল্টাতে হবে। একটা শিশুকে কেন এতগুলি পাঠ্য বই পড়তে হবে? যার অধিকাংশের প্রতি তার কোনও আগ্রহ নেই? সকল শিশুকে সকল বিষয়ে এক্সপার্ট বা পণ্ডিত করে তোলা প্রাথমিক শিক্ষার মূল লক্ষ্য নয়। বিষয়ের প্রতি অভিমুখী করাই মূল কাজ। একটা শিশুকে কেন সব বিষয়ে এক্সপার্ট হতে হবে? কোনও বিষয়ের প্রতি শিক্ষার্থীর আগ্রহ না থাকলে তাকে সে বিষয়ে অভিমুখী করা যায় না। পড়াশোনার ক্ষেত্রে শিশুদের আগ্রহকে অবশ্যই মূল্য দিতে হবে।

প্রাথমিক স্তরে পঠনপাঠনের বিষয়গুলির সঙ্গে খেলাধুলা-শরীরচর্চা, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতামূলক কাজ, উৎপাদনাত্মক কাজ, সৃজনাত্মক কাজ যাতে নাচ গান বিষয় হিসাবে আছে— এগুলিকেই গুরুত্ব দিতে হবে। উক্ত বিষয়গুলির মধ্যে কোনওটিতেই আগ্রহ নেই, এমন ছাত্রছাত্রী পাওয়া যাবে না। বিষয়গুলির মধ্যে শিশুর (দশটাই হোক, পাঁচটাই হোক, আর একটাই হোক) কোনও না কোনও বিষয়ের প্রতি বিশেষ আগ্রহ, দখল আর পারদর্শিতা থাকলে, কোনও শিশুকে কোনও শ্রেণিতে আটকে রাখাটা সর্বনাশা অপরাধের মধ্যে পড়ে।

যার যে বিষয়ে আগ্রহ, দখল আর পারদর্শিতা আছে— তাকে সে বিষয়েই উচ্চতর থেকে উচ্চতম স্তরে পড়ার সুযোগ করে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, আজকের যুগটা হল স্পেশালিস্টের যুগ। সব বিষয়ে হাফজান্তা না-হয়ে এক বিষয়ে ফুলজান্তা হতে হবে শৈশব থেকেই।

Jadavpur University Student
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy