পুনর্জিৎ রায়চৌধুরীর ‘যাহা পাই তাহা চাই না’ (১৯-৭) এবং আফরোজা খাতুনের ‘মেয়ে-ক্রেতার বাড়তি গচ্চা’ (১৫-৭) লেখা দু’টির মূলে রয়েছে মানুষের নিজের জীবনযাপন, জীবিকা, চেহারা নিয়ে অসন্তুষ্টি, অ-সুখ। আমরা বাজার থেকে ‘ভাল থাকা’ কিনি, এবং এই পৃথিবীতে প্রত্যেকের ভাল থাকার অধিকার আছে। কিন্তু সমস্যা তখনই হয় যখন কেউ অন্যের জীবনের দিকে আঙুল তুলে তাকে আর তার বেঁচে থাকাকে ভুল প্রমাণ করার জন্য হাজারো খুঁত খুঁজে বার করে সেই মানুষটিকে আঘাত করার মাধ্যমে নিজের না পাওয়া, খেদ, বিরক্তি মেটায়।
সেই জন্যই মানুষ অজস্র বিকল্পের ভিতর ‘সেরা’-টা খুঁজে নিয়ে সবাইকে দেখিয়ে দিতে চায় আমিই সেরা, আমার জীবন নিখুঁত! এই দেখিয়ে দেওয়ার মধ্যে কতটা তার নিজের সুখ আছে আর কতটা অন্যকে ভুল প্রমাণ করার চ্যালেঞ্জ আছে তা ভাবার বিষয়। অথচ যারা জীবনের ছোট-বড় সুখ-দুঃখ নিয়ে বেঁচে থাকার আনন্দে দিন কাটায় তাদেরই ওই প্রথম শ্রেণির আপাত সফল মানুষেরা খোঁটা দিয়ে বলে, এরা জীবনটাকে বাঁচল কই! বাজারই মানুষের সাফল্যের মাপকাঠি নির্ধারণ করে, বাজারই রূপ-গুণের বিচার করে, আর এই বাজার মানুষেরই তৈরি। তাই আফরোজা খাতুন পিতৃতান্ত্রিক বাজারের দিকে আঙুল তুলে “‘পিঙ্ক ট্যাক্স’— মেয়ে হওয়ার গুনাগার”-এর কথা বলেছেন ঠিকই, সঙ্গে আমি বলব ওই একই বাজার নারীর পাশাপাশি পুরুষকেও, বা বলা ভাল মানুষকে অজস্র বিকল্পের মধ্যে থেকে ভাল থাকা বা তথাকথিত সাফল্যের চিহ্ন খুঁজে নিতে বাধ্য করে, প্রতি মুহূর্তে তার সামনে অসংখ্য ‘ভাল থাকা’র তুল্যমূল্য নমুনা পেশ করে তাকে বিভ্রান্ত করে। বিনিময়ে তাকে মাসুল বা ট্যাক্স হিসাবে দিতে হয় জীবনভরের তুলনা, অতৃপ্তি, অসন্তুষ্টি, আত্ম-সন্দেহ, অনুশোচনা।
অনিশা ঘোষ, পাণ্ডুয়া, হুগলি
সুখ না শান্তি?
পুনর্জিৎ রায়চৌধুরীর ‘যাহা পাই তাহা চাই না’ শীর্ষক অত্যন্ত মূল্যবান প্রবন্ধটির পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি কথা তুলে ধরতে চাই।
বর্তমান যুগে বহু সংখ্যক মানুষের মন অশান্ত ও অস্থিরতার শিকার। আমরা যতই আধুনিক হচ্ছি, ততই যেন তাৎক্ষণিকতার জালে জড়িয়ে পড়ছি। আমাদের ধীশক্তি অনেক কমছে। আমাদের সব কিছু ‘এখনই চাই’ এই মানসিকতা বেড়ে যাচ্ছে। সেই কারণে ‘ইনস্ট্যান্ট’ কফি, ‘ইনস্ট্যান্ট’ টাকা-র মতো এখনই সুখ, এখনই সাফল্য লাভের ঝোঁকও ক্রমশ বাড়ছে।
এখন তো অসংখ্য বিকল্পেরই যুগ চলছে, ফলে আমরা নিজের মতামত বোঝার আগেই অন্যের দ্বারা বেশি প্রভাবিত হচ্ছি, বিশেষত বিজ্ঞাপনের প্রভাবে যথেষ্ট পরিমাণে এমনটাই ঘটছে। তাই আজ সব কিছু পেয়েও সব কিছুতেই বড় একঘেয়েমি লাগে আমাদের। তার কারণ সেটি আমাদের হৃদয়ের প্রাপ্তি নয়। তাই প্রতি বছর দুর্গাপুজোর সময় আমরা সাম্প্রতিক ফ্যাশনের পোশাক কিনতে চাই। একটি গাড়ি কিছু দিন ব্যবহার করার পরেই সেটি বদলে নতুন মডেলের গাড়ি কিনি। টিভি, ফোন ইত্যাদি সব কিছুই নতুন রাখতে চাই। এমনকি স্মার্টফোন কেনার এক বছরের মধ্যেই যেন মনে হয় আর কিছু দিন অপেক্ষা করে কিনলেই ভাল হত, তা হলে ‘লেটেস্ট মডেল’টা পেতাম। আধুনিক পৃথিবীতে এমনও তো দেখেছি, বিয়ে করেও অনেকে মনে করছেন, আর একটু অপেক্ষা করলে আরও মনের মতো সঙ্গী পেতাম। অর্থাৎ মন অশান্ত, অস্থির তাই কোনও কিছুতেই তৃপ্তি নেই।
লেখক আমাদের এক নিদারুণ মনস্তাত্ত্বিক সমস্যাকে চিহ্নিত করেছেন। যে-হেতু আমরা চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখছি না, বরং অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতার জন্য নিজেদের চাহিদাকে সীমাহীন করে তুলছি, স্বাভাবিক ভাবেই কোনও অবস্থাতেই শান্তি পাচ্ছি না। একটু তথ্য নিলে দেখা যাবে, আমরা সীমাহীন বিকল্পের হাতছানিতে মোহগ্ৰস্ত হয়ে যত পোশাক কিনি তার ৪০ শতাংশই অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয়। বছরের পর বছর আলমারিতে পড়ে থেকে নষ্ট হয় কত অপ্রয়োজনীয় পোশাক।
এই বেশি বেশি চাওয়া প্রকৃতপক্ষে আমাদের মূল্যবোধের অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ। সীমাহীন চাহিদা পূরণ করতে প্রয়োজনে অসৎ পথে অর্থ উপার্জন করতে এগিয়ে চলেছে মানুষ। আসলে সুখ, আনন্দ ও শান্তির মধ্যে পার্থক্য অনেক। সুখ হল ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে ভোগ করা। ইন্দ্রিয়ই সেখানে প্রধান ভূমিকায়। উত্তেজনার প্রবাহ। ক্লান্তি তার পরিণতি। এই সুখের কামনা পেয়ে বসলে মানুষ মানবিক গুণ হারিয়ে ফেলতেই পারে। কারণ মানুষ তখন বিষয়বস্তুকে অধিকার করার চেষ্টা শুরু করে।
অন্য দিকে, আনন্দ হল মনের সাহায্যে ভোগ করা। সেখানে মনই প্রধান। কবি, শিল্পী, বিজ্ঞানী, দার্শনিক প্রমুখ উচ্চ চিন্তার প্রভাবে এই আনন্দ পান। প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখলে আনন্দে মন ভরে ওঠে, কিন্তু প্রকৃতির দৃশ্যকে দখল করতে চান না। আর শান্তি হল জাগতিক বিষয়কে নগণ্য জ্ঞান করে আনন্দ পাওয়া। মন শান্ত হলেই শান্তি আসে। সুতরাং, আধুনিক পৃথিবী ক্রমাগত আমাদের সামনে নিত্যনতুন বিকল্প হাজির করবে এটা স্বাভাবিক, কিন্তু আমাদের শান্তি ও আনন্দ নিয়ে বেঁচে থাকতে হলে বাইরের সম্পদের প্রতি সীমাহীন চাহিদা কমিয়ে অন্তরের সম্পদকে গুরুত্ব দিতে হবে। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, আত্মবিশ্বাস, ভালবাসা, সাহস, করুণা প্রভৃতিকে বিকশিত করতে হবে। মূল্যবোধ কিন্তু গড়ে ওঠে অন্তরের সম্পদের ভিত্তিতে। এই মূল্যবোধকে ধরে রাখাতেই তো জীবনের সাফল্য।
সন্দীপ সিংহ, হরিপাল, হুগলি
দৌড়ে চলেছে
পুনর্জিৎ রায়চৌধুরীর ‘যাহা পাই তাহা চাই না’ শীর্ষক প্রবন্ধটি পড়ে অনেক চিন্তা মনে এল। প্রাবন্ধিক এখানে কিন্তু আগাগোড়া এই সমাজের মন-চিকিৎসকের ভূমিকাই পালন করেছেন। দেখা যাচ্ছে একমাত্র শিশুদের উপরে ভর করেই কিছু সংখ্যক মা-বাবা তাঁদের অপূর্ণ স্বপ্নকে পূরণ করতে উঠেপড়ে লাগছেন। শুরু হচ্ছে বহু বিকল্পের সন্ধান। নাচ, গান, কবিতা, আঁকা, ক্যারাটে, সাঁতারের হাত ধরে অনিচ্ছাসত্ত্বেও শিশুরা জীবনের শুরু থেকেই বহু বিকল্পের ফাঁদে পড়ে যাচ্ছে। হয় নাচে পটু হও, তা না পারলে আঁকায় প্রাইজ় আনো। পাশাপাশি থাকছেই ক্লাসের পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার চাপ। এ যেন ম্যারাথন দৌড়। ক্রমশ যন্ত্রে পরিণত হচ্ছে তারা। কোন কাজটি ভাল ভাবে সম্পন্ন করলে বাবা-মাকে একটু খুশি করা যাবে শিশুমন তা কি তা আর বুঝে উঠতে পারে? তাই সব রেস-এই দৌড়চ্ছে তারা। ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে।
তাই হেরে যাওয়ার ভয় ঘিরে থাকছে ওদের। দেখা যাচ্ছে, খেলাধুলার চর্চা স্কুল-কলেজে সার্বিক ভাবেই কমে গিয়েছে। কোথাও কোথাও তো একেবারেই নেই। হেরে যাওয়ার মধ্যে যে জেতার রসদই লুকিয়ে আছে, এ প্রজন্ম সে সংবাদ জানতেই পারছে না। মনে রাখতে হবে ‘বহু বিকল্প’ জিতে যাওয়ার আনন্দ দিলেও পূর্ণতার তৃপ্তি দিতে পারে না।
স্কুলের পরে, বহু টিউশনি পড়ার পরও “পড়া আছে” বলে যখন ছাত্ররা ছুটি চাইতে আসে, তখন প্রশ্ন জাগে। বহু বিকল্পের হাতছানির মাঝে, এত টিউশনি পড়ার পরেও নিয়মিত পড়া তৈরি করতে ব্যর্থ হচ্ছে কি ওরা? এই ঘটনাকে আমরা কী বলব? অধিক বিকল্পের সন্ধান নাকি আত্মবিশ্বাসের অভাব? মোট কথা, শৈশব-কৈশোরকে ভাল ভাবে যাপন করার সুযোগ না দিলে ভবিষ্যতে অসুখী মানুষের সংখ্যা ক্রমশ বাড়বে।
দীপায়ন প্রামাণিক, গোবরডাঙা, উত্তর ২৪ পরগনা
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)