প্রেমাংশু চৌধুরী তাঁর ‘কেবলই ছবি, না কি দেশ’ (১৫-৫) প্রবন্ধটি যেখানে শেষ করেছেন, আমি ঠিক সেখান থেকেই শুরু করতে চাই। প্রবন্ধের শেষ বাক্যটি হল “কর্নেল সোফিয়া কুরেশি ও উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিংহের পাশাপাশি ছবি প্রতীকী হয়েই থেকে যাবে কি না, সেটাই এখন দেখার।” বস্তুত, সেটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন। সমাজজীবনে ‘প্রকৃত’ ভারতবর্ষের অনুপস্থিতি যখনই প্রকট হয়, তখনই ‘প্রতীক’-এর প্রয়োজনটা বেশি করে দেখা দেয়। ‘অপারেশন সিঁদুর’ নিয়ে প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে এক পাশে মুসলিম কন্যা কর্নেল সোফিয়া কুরেশি এবং অন্য পাশে হিন্দু ললনা উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিংহকে নিয়ে বিদেশ সচিব বিক্রম মিস্রীর উপস্থিতি নিঃসন্দেহে এই যুদ্ধের আবহেও একটা সুখকর ‘চিত্র’ রচনা করে। কিন্তু, প্রশ্নটা সেখানে নয়। প্রশ্নটা হল, এ রকম প্রতীকের প্রয়োজন হচ্ছে কেন এখন? আমাদের দেশে তো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সংক্রান্ত প্রতীক বা বাণীর অভাব নেই। কবিতায়, সঙ্গীতে ও ছবিতে তার ছড়াছড়ি। ভারতীয় সাধনার মূলমন্ত্রই তো বহুর মধ্যে একের অন্বেষণ। আমাদের জাতীয় সঙ্গীত ‘জনগণমন-অধিনায়ক’-এও রয়েছে বহুত্বের কথা। কাজী নজরুল ইসলামের ‘মোরা একই বৃন্তে দু’টি কুসুম হিন্দু-মুসলমান’— বিখ্যাত এই পঙ্ক্তিটি কে-ই বা ভুলতে পারে? সর্বধর্ম সমন্বয়ে গঠিত নেতাজির ‘আজাদ-হিন্দ-ফৌজ’ও তো সংহতির আদর্শ বহন করে।
অথচ, এত কিছু থাকা সত্ত্বেও এখনও এ দেশের আকাশ-বাতাস সাম্প্রদায়িকতার বিষে মাঝেমধ্যেই বিষাক্ত হয়ে ওঠে। এটাই তো প্রমাণ করে শুধুমাত্র ‘প্রতীক’ ব্যবহারের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির লক্ষ্যে পৌঁছনো কোনও ভাবেই সম্ভব নয়। তার সঙ্গে প্রয়োজন মনের পরিচর্যা, যাতে সকলের মধ্যে জেগে ওঠে সৌহার্দের মানসিকতা আর লুপ্ত হয়ে যায় পরস্পরের প্রতি ঘৃণা, বিদ্বেষ।
‘সংহতি’ বোঝাতে শুধুমাত্র ‘প্রতীক’-এর ব্যবহার যে কতটা অসার, সরকারি তরফে সম্প্রীতির উপরোক্ত ‘প্রতীক’ প্রদর্শনের সমসময়েই বিদেশ সচিব বিক্রম মিস্রীকে (যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরে) এবং পহেলগামের সন্ত্রাসবাদী হামলায় নিহত নৌসেনার আধিকারিক বিনয় নারওয়ালের স্ত্রী হিমাংশীকে (হামলায় সমস্ত কাশ্মীরি ও গোটা মুসলিম সমাজকে দায়ী না করার আর্জিতে) নেট দুনিয়ার উগ্র জাতীয়তাবাদীদের ভাষিক আক্রমণ থেকেই টের পাওয়া যায়। মানুষের মনে যদি গভীর ভাবে প্রোথিত থাকে অপরের প্রতি, অন্য ধর্মের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ, তবে তা দূর করা সত্যিই খুব কঠিন। কিন্তু, থেমে থাকলেও তো চলবে না। সম্প্রীতি বজায় রাখার অনুশীলন আমাদের নিরন্তর চালিয়ে যেতে হবে। এবং এই কাজে সরকারের সঙ্গে দেশের প্রত্যেক নাগরিকেরও সমান দায়িত্ব।
গৌতম নারায়ণ দেব, কলকাতা-৭৪
বিভাজনের নীতি
প্রেমাংশু চৌধুরী তাঁর প্রবন্ধে কিছু প্রাসঙ্গিক কথা তুলে ধরেছেন। কিন্তু আরও কিছু সংযোজন করা প্রয়োজন বলে মনে করি। হিন্দু-মুসলমানের দ্বন্দ্বে প্রবন্ধকার কেবল রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রকেই সামনে এনেছেন, ভোট বৈতরণি পার হওয়ার একমাত্র উপায় হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন। কিন্তু এখানে আরও কিছু বিষয় উল্লেখ না করলে চিত্রটি সম্পূর্ণ হয় না।
মনে রাখতে হবে, কেবল রাজনীতির নিরিখে বিচার করলে সঠিক বিচার মিলবে না। বিষয়টি শুরু থেকে লক্ষ করা যাক। প্রবন্ধকার কথা শুরু করছেন এ ভাবে— এক দিকে কর্নেল সোফিয়া কুরেশি। গুজরাতের মুসলিম পরিবারের সন্তান। অন্য দিকে, উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিংহ। লখনউয়ের কন্যা, হরিয়ানার পুত্রবধূ। মাঝে বিদেশ সচিব বিক্রম মিস্রী। কাশ্মীরি পণ্ডিত। দেশ নয়, ধর্ম পরিচয় দিয়েই যেন দেশের বীর সন্তানদের চিনছি আমরা। কিন্তু কেন? উত্তর অন্বেষণে একটু পিছিয়ে যেতে হবে আমাদের। সোফিয়া কুরেশি কিংবা ব্যোমিকা সিংহ তো ধর্ম পরিচয়ে তাঁদের পদটিতে আসীন হননি। আসীন হয়েছেন নিজেদের যোগ্যতার বলে। তা হলে তাঁদের ধর্ম পরিচয় নিয়ে এত আলোচনা হচ্ছে কেন? এর উত্তর হল— রাজনীতি। যার জেরে অন্য ধর্মের প্রতি মনে বাসা বাঁধে সন্দেহ, বাড়ে পারস্পরিক দূরত্ব। মাঝে-মাঝে এই দূরত্ব কমানোর যেটুকু চেষ্টা করা হয়, তা মূলত লোকদেখানো, অথবা তার সঙ্গে রাজনৈতিক স্বার্থ জড়িত থাকে।
সাধারণ মানুষের আবেগের সুযোগে ধর্ম নিয়ে উন্মাদনা তৈরি করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের উচিত নিরপেক্ষ থাকা। বাস্তবে তা হয় না। মসজিদের পাল্টা মন্দির তৈরি হয়। রাষ্ট্র টাকার জোগান দেয়। সামান্য মাধ্যমিক পরীক্ষায় সফল ছাত্রছাত্রীর নামের আগেও ধর্ম পরিচয়কে একটি বিশেষ কৃতিত্ব হিসেবে দেখানো হয়। বলা হয় মুসলিম ছেলেটি প্রথম হয়েছে। অথবা, অমুক জনজাতির মেয়ে ভাল রেজ়াল্ট করেছে। ছেলেটি বা মেয়েটির জাতি পরিচয় দেওয়ার গুরুত্ব কতখানি? আমরা কখনও ভেবে দেখেছি কি এতে তারা অপমানিত হয় কি না? ভেবে দেখেছি কি ভিতরে-ভিতরে বিভেদের রেখাটি ক্রমশ আরও কত চওড়া হচ্ছে? খেয়াল করলে দেখা যাবে বঞ্চনার একটি প্রেক্ষাপটকে উস্কে দিতেই ধর্ম পরিচয় এ সব ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা নেয়। আসলে, এ দেশে দলীয় রাজনীতি যে সব। এ দেশে দল আর রাষ্ট্রকে গুলিয়ে দেওয়ার ইতিহাস আছে। এ দেশ তো সকলের— সেই সত্যকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলে প্রতিনিয়ত। নয়তো দেশের পরিচয়ে মানুষকে চিনিয়ে দিতে সমস্যা কোথায়?
শুধু অন্য ধর্মই নয়, সহনাগরিক নিম্নবর্ণের হিন্দুর জন্যও ফতোয়া জারি হয় তথাকথিত উচ্চবর্ণের হিন্দুদের তরফে। হিন্দু হয়ে হিন্দুর কাছে নিপীড়নের শিকার হওয়া মানুষগুলির বঞ্চনার সেই ইতিহাসের চর্চা আজও কি থেমে গিয়েছে? থামেনি। আজকের এই বিরোধ সেই চর্চারই কুফল নয় তো? পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনির-এর কথাতেও ধরা পড়েছে সেই সত্য। ‘আমাদের আচার পৃথক, সংস্কৃতি পৃথক’ বলে তিনি বিভাজনের খেলাটিকে আপ্রাণ জিইয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন। এবং সফলও হয়েছেন। এ দেশেও সমান তালে খেলাটি চলছে। এই বিভাজনের খেলা তখনই বন্ধ হবে যখন আমরা অন্য সম্প্রদায়ের বৈচিত্রকে স্বীকার করে নিতে পারি। জোর করে মেলাতে গেলেই সমস্যা বাড়বে। বরং এ ক্ষেত্রে উভয় পক্ষকেই এগিয়ে আসতে হবে। এক পক্ষের দ্বারা সমস্যার সমাধান হবে না। পারস্পরিক শ্রদ্ধা জাগাতে দু’পক্ষকেই দায়িত্ব নিতে হবে।
সেই সঙ্গে চাই রাষ্ট্রের সদিচ্ছা। রাষ্ট্র যদি ব্যক্তির ধর্মীয় পরিচয়ের চেয়ে দেশের পরিচয়কে গুরুত্ব দিতে পারে, তবে অচিরেই দ্বন্দ্বের অবসান হবে। নতুবা সম্প্রীতির ছবি যতই ঝকঝক করুক, ভিতরের ভাঙন রোধ করা কঠিন হয়ে পড়বে।
দীপায়ন প্রামাণিক, গড়পাড়া, উত্তর ২৪ পরগনা
কষ্টের যাত্রা
সল্ট লেক, রাজারহাট, নিউ টাউনে অবস্থিত আইটি সেক্টর, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নিয়মিত যাতায়াত করেন বহু মানুষ। দুর্ভাগ্যের বিষয়, যাঁরা এখন উবর শাটল বাসে যাতায়াত করেন, তাঁদের অপরিসীম কষ্টের শিকার হতে হচ্ছে। বেশির ভাগ দিন এক ঘণ্টার পথ আসতে তিন ঘণ্টা লেগে যায়। কেননা এই বাসগুলি মা ফ্লাইওভার দিয়ে এখন যাতায়াত করতে পারে না। যদিও আগে সেই অনুমতি ছিল। সেতুর নীচ দিয়ে পার্ক সার্কাস হয়ে আসতে হয়। সেখানে অকল্পনীয় জ্যামে হামেশাই ঘণ্টাখানেক দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। কখনও আবার ট্র্যাফিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে পুলিশ বাস আটকায়, পরিণামে আরও বিলম্ব। এমনিতেই কলকাতার রাস্তায় যান চলাচল ব্যবস্থাপনা প্রায় নেই-ই। প্রতিনিয়ত যানজটই তার প্রমাণ। মা ফ্লাইওভার যে সব গাড়ি ব্যবহার করতে পারে না, তাদের জন্য অন্য রাস্তাটি যেন যানজটমুক্ত থাকে, সেই ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানাই।
অলোক রায়, কলকাতা-৮
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)