পল্লব ভট্টাচার্যের ‘ভাঙা, হেলা বাড়ির শহর’ (১১-২) প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। অবৈধ নির্মাণের বাস্তুতন্ত্রে যুক্ত বাস্তুঘুঘুদের লালসার শিকার থেকে এখন উন্নয়নের চুন-সুরকিও বাদ যায় না। তাই কাঠামোগুলি উন্নয়নের সাক্ষী হয়ে টিকে থাকতে পারছে না। বরং পুনর্নির্মাণের হাতছানি দিয়ে আরও বেশি লাভের সম্ভাবনা দেখিয়ে হেলে পড়ছে প্রতিবেশী কাঠামোর দিকে। আইনি কাঠামোগুলির ঘাড়ের উপরে যে ভাবে বেআইনি কাঠামোর নিঃশ্বাস পড়ছে, তাতে বৈধ কাঠামোগুলির ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন উঠে আসছে। যত্রতত্র যে ভাবে অবৈধ নির্মাণ ছাড়পত্র পাচ্ছে, তাতে কোনটি কার উপর হেলে পড়বে, তা নিয়েও যথেষ্ট সংশয় থাকছে। প্রকল্পের খরচ কমিয়ে বাড়তি লাভের আশায় মাটি পরীক্ষা ছাড়াই নির্মিত কাঠামোর ভিত বিপন্ন করে তুলছে কাঠামোর ভবিষ্যৎ। গাঙ্গেয় অববাহিকায় অবস্থিত কলকাতা শহরের মাটি এমনিতেই নরম, ভারবহনের ক্ষমতা তুলনায় কম। তার উপর জলাজমি বুজিয়ে ঘটে চলেছে একের পর এক অবৈধ নির্মাণ। অগভীর ভিতের বাড়ি অথবা নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবহারে তৈরি কাঠামোগুলি হেলে পড়ছে অথবা ভেঙে পড়ছে তৈরি হওয়ার দশ-পনেরো বছরের মধ্যেই।
এক দিকে শহর অভিমুখী মানুষের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। কলকাতা শহর ফুলে-ফেঁপে শহরতলির মাঠ-ঘাট, জলাজমি বুজিয়ে উন্নয়নের ফোয়ারা ছোটাচ্ছে প্রশাসন। আর অন্য দিকে, শহরকে জায়গা করে দেওয়ার জন্য প্রকৃতি ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে চলেছে। পূর্ব কলকাতার ই এম বাইপাস সংলগ্ন এলাকায় বড় বড় জলাশয় বুজিয়ে বহুতল বাড়ি তৈরি হচ্ছে দিনে-দুপুরে। তিনশো বছর পেরিয়ে যাওয়া কলকাতায় মানুষের ভয়াবহ জনঘনত্ব এবং বাড়ির সংখ্যাবৃদ্ধি উদ্বেগজনক আকার ধারণ করেছে। তা সত্ত্বেও শহরের ধারণক্ষমতা ছাপিয়ে অবৈধ নির্মাণ হয়ে চলেছে সর্বত্র।
কলকাতা শহরে কোন এলাকায় কেমন ধরনের আবাসন ঝুঁকিহীন ভাবে নির্মাণ করা সম্ভব, তার জন্য কোনও সমীক্ষা হয়েছে কি? উল্টে নগরের ব্যাপ্তি বেড়েছে বহু গুণ। প্রবন্ধের একটি তথ্য চমকে দেওয়ার মতো। কলকাতা শহরের ষোলোটি বরো এলাকায় গত ২৮ জুন থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত বেআইনি নির্মাণের অভিযোগ জমা পড়েছিল ৫২৫টি। যার মধ্যে ভাঙা হয়েছে মাত্র ২৬৪টি বাড়ি। সুতরাং স্পষ্ট যে, কঠোর ভাবে অবৈধ নির্মাণে কিছুতেই লাগাম পরানো যাচ্ছে না বা পরাতে চাওয়া হচ্ছে না। কারণ, অবৈধ নির্মাণের বাস্তুতন্ত্রে প্রভাবশালীরাও জড়িয়ে আছেন। বাড়তি লাভের লক্ষ্যে তাঁরাও বুঝতে চান না যে, হেলে পড়া বাড়ির স্থায়িত্বের সঙ্গে জুড়ে আছে তার আশপাশের বাড়িগুলির সুরক্ষাও। তা ছাড়া কলকাতা শহরের বহু এলাকা ভূমিকম্পের নিরিখে ঝুঁকিপ্রবণ। সতর্ক না হলে, আগামী দিনে সঙ্কট আরও বাড়বে। তাই বৃহত্তর বিপর্যয় মোকাবিলার প্রস্তুতি হিসাবে সরকার এবং পুরসভাকে অবৈধ নির্মাণে রাশ টানতেই হবে।
অজয় ভট্টাচার্য, বনগাঁ, উত্তর ২৪ পরগনা
অসহায় বাসিন্দা
কলকাতা ও শহরতলিতে একের পর এক বহুতল হেলে পড়ার ঘটনায় উদ্বেগ ছড়িয়েছে মানুষের মধ্যে। বাঘাযতীন, ট্যাংরা, মুকুন্দপুর, বাগুইআটি— কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে বহুতল আবাসন তৈরি হওয়ার সময় নিম্নমানের মালমশলা ব্যবহারের অভিযোগ উঠছে। কলকাতার মাটির নীচে থাকা পলিমাটির ভারবহন ক্ষমতা তুলনায় কম। এ ছাড়াও শহরের বহু অংশে জলাজমি, নিচু জমি, মজে যাওয়া পুকুর, খাল বুজিয়ে নির্মিত হচ্ছে একের পর এক বহুতল। নরম মাটিতে অগভীর ভিতের বাড়িতে ছেয়ে গেছে সারা শহর। কিন্তু নির্মাণের সময় তা খতিয়ে দেখেননি পুরসভার বিল্ডিং বিভাগের ইঞ্জিনিয়াররা। যে কোনও বাড়ি নির্মাণের সময় প্ল্যান অনুযায়ী বাড়ি নির্মাণ হচ্ছে কি না, তা দেখা পুরসভার ইঞ্জিনিয়ারদের দায়িত্ব। নির্মাণের বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ যথাযথ ভাবে অর্থাৎ প্ল্যান অনুযায়ী হচ্ছে কি না, তাও খুঁটিয়ে দেখা তাঁদের দায়িত্ব। তা ছাড়া প্ল্যান বহির্ভূত কাজ এবং ভাল মানের মালমশলা ব্যবহার করা না হলে তাঁরা বাধা দেবেন, এটাই কাম্য। কিন্তু কলকাতা পুরসভা ও তার বিল্ডিং বিভাগের ইঞ্জিনিয়ারদের কাজে গাফিলতির সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির অসাধু প্রোমোটার কলকাতা ও শহরতলি জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
কলোনি ও বস্তি এলাকায় যে বহুতলগুলি নির্মিত হয়, সেখানে বিল্ডিংয়ের চার দিকে কতটা জমি ছাড়া হল তার পরোয়া করেন না কেউই। সবাই নিয়ম ভেঙে যতটা বেশি জায়গা জুড়ে বাড়ি করা যায়, তার চেষ্টা করেন। তা ছাড়া বস্তি এলাকায় প্ল্যানে যে ক’টি তলের জন্য ছাড়পত্র দেওয়া হয়, তার থেকে অনেক বেশি তল বেআইনি ভাবে নির্মাণ করা হয়। কেউই নিয়মের পরোয়া করেন না বলে কোনও অভিযোগও জমা পড়ে না। ফলে কোনও তৎপরতাও দেখায় না পুরসভা। কলকাতার কলোনি এলাকায় নির্মাণের ক্ষেত্রে পুর আইনের কিছু ছাড় থাকলেও, বাড়ির কাঠামোগত স্থায়িত্ব কিংবা মাটির ধারণক্ষমতা যাচাই ছাড়া বহুতল নির্মাণের উপর নিয়ন্ত্রণ সেখানেও জরুরি। কলকাতা পুরসভার মহানাগরিক ফিরহাদ হাকিম বলেছেন, বেআইনি নির্মাণ রোধে তিনি বদ্ধপরিকর। তবে গোটা শহরের কোথায় কোথায় বেআইনি বাড়ি তৈরি হচ্ছে, তা খুঁজে বার করা পুরসভার একার পক্ষে সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষেরও এ ব্যাপারে পুরসভার সঙ্গে সহযোগিতা করা উচিত। বিরোধীরা অবশ্য এই সব অবৈধ নির্মাণের সমস্ত দায় শাসক দলের উপর চাপিয়ে দিতে চান। সরকার পক্ষের অভিযোগ, এই প্রোমোটার রাজ শুরু হয়েছে আগের বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই। এই রাজনৈতিক তরজায় অসহায় অবস্থা সেই সব বাসিন্দার, যাঁরা বহু টাকা ব্যয় করে ফ্ল্যাটগুলি কিনেছেন!
রবীন রায়, শ্যামনগর, উত্তর ২৪ পরগনা
সচেতনতা চাই
পল্লব ভট্টাচার্যের প্রবন্ধটির শিরোনাম অনভিপ্রেত বলেই মনে হয়। শহরের কিছু অবৈধ ও ত্রুটিপূর্ণ বাড়ির দায় কোনও মতেই সমস্ত শহরবাসীর উপর বর্তায় না। তবে প্রবন্ধের মূল বিষয়ে দ্বিমত পোষণের খুব একটা অবকাশ আছে বলে মনে হয় না। অবৈধ নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রবন্ধকার যে ভাবে পুর-কর্তৃপক্ষের শিথিলতা এবং এর বিরুদ্ধে মামলা হলে আদালতের বাইরে মীমাংসার কথা উল্লেখ করেছেন, তা কোনও ভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়। এই ধরনের ঘটনায় প্রশাসনকে পদক্ষেপ করতেই হবে। আবার প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা যায়, কোনও বাড়ি বা আবাসন ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রথমেই দোষী সাব্যস্ত করা হয় সংশ্লিষ্ট প্রোমোটারকে। অথচ, অবৈধ বা ত্রুটিপূর্ণ নির্মাণের ছাড়পত্রের জন্য প্রধানত দায়ী করা যেতে পারে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের জনপ্রতিনিধি এবং এই বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুর বা পঞ্চায়েত কর্মীদেরও। তবে কেনার সময় চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়ার আগেই সংশ্লিষ্ট বাড়ি বা আবাসনের প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়ে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
যখন কোনও অবৈধ নির্মাণ দিনের পর দিন চলতে থাকে, তখন কোনও বিরোধী দলকেই প্রতিবাদে এগিয়ে আসতে দেখা যায় না। অথচ নির্মাণ হেলে বা ভেঙে পড়লে প্রতিবাদের ঢেউ আছড়ে পড়ে তাঁদের কণ্ঠে, যেন এই দিনটার অপেক্ষাতেই ছিলেন তাঁরা। এই অবৈধ নির্মাণের দায় কমবেশি সবার। রাজনীতি এড়িয়ে সদর্থক চিন্তা, সচেতনতা খুবই প্রয়োজন এই ক্ষেত্রে।
অশোক দাশ, রিষড়া, হুগলি
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)