E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: ভুক্তভোগী মানুষ

অন্য রাজ্যে বাংলাদেশি পরিচয় দাগিয়ে দিয়ে বাঙালি বিতাড়নের যে ঢেউ উঠেছে, তাতে এর আড়ালে মুসলমানদের কোণঠাসা করাই মুখ্য উদ্দেশ্য, সেটা বুঝতে বাকি নেই।

শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০২৫ ০৬:০০

বাঙালি জাতিসত্তা নিয়ে রাজনীতিতে চাপানউতোর এবং তার থেকে শুধুমাত্র নির্বাচনী পাটিগণিতে জয়লাভের অঙ্ক সমাধানের তাগিদে যে ভাবে উঠে পড়ে লেগেছে প্রধানত রাজ্যের ও কেন্দ্রের শাসক দল, সেই পরিপ্রেক্ষিতে অমিতাভ গুপ্তের ‘বহিষ্কার নয়, অন্তর্ভুক্তি’ (১-৮) শীর্ষক প্রবন্ধটি খুবই প্রাসঙ্গিক। অন্য রাজ্যে বাংলাদেশি পরিচয় দাগিয়ে দিয়ে বাঙালি বিতাড়নের যে ঢেউ উঠেছে, তাতে এর আড়ালে মুসলমানদের কোণঠাসা করাই মুখ্য উদ্দেশ্য, সেটা বুঝতে বাকি নেই। সমস্ত ঘটনাকে বাঙালি মোড়কে যতই দেখানোর চেষ্টা হোক, সব ছাপিয়ে প্রাধান্য পাচ্ছে মেরুকরণের রাজনীতি, যার ফল ভোগ করছেন এক শ্রেণির মানুষ।

হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রধান কৌশল হল, উত্তর ভারতীয় হিন্দু সংস্কৃতি ও ধর্মীয় আচার-আচরণ এই রাজ্যে প্রতিষ্ঠা করে বাংলার সংস্কৃতিকে ধ্বংস করা। যদিও অন্য ভাষার মানুষের প্রতি বিদ্বেষ শুধুমাত্র রাজনৈতিক সংস্কৃতির দিক থেকে নয়, বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি ও চরিত্রের সঙ্গেও খাপ খায় না। তবে বাঙালির সংস্কৃতি অন্যদের কাছে যথেষ্টই শিক্ষণীয়। লাঞ্ছনা-সহ বাঙালি বিতাড়নের এই দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের বাইরে থাকা পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতি ফিরে আসার যে আহ্বান জানিয়েছেন, মানবিক দিক থেকে তা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।

বাঙালি অস্মিতা যতই জাগ্রত করার চেষ্টা চলুক, এর ফলে এবং এই দ্বন্দ্বে ক্ষতিগ্রস্ত ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। রাজনৈতিক কারবারিরা দরিদ্র মানুষের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটাতে ব্যর্থ হয়ে, নজর ঘুরিয়ে দিচ্ছেন ধর্মীয় মেরুকরণ ও এই তথাকথিত প্রাদেশিকতার আড়ালে। ‘বাঙালি খেদাও’-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ যেমন জারি রাখতে হবে, তেমনই প্রত্যেক শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বাঙালিকে নিজের অস্মিতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য স্মরণ রাখতে হবে ঐতিহ্যকে। বানচাল করে দিতে হবে রাজনীতির আবহে মানুষের দুঃখ-কষ্ট ভুলিয়ে রাখার অনৈতিক কৌশল।

অশোক দাশ, রিষড়া, হুগলি

সঙ্কটকালে

‘বহিষ্কার নয়, অন্তর্ভুক্তি’ প্রবন্ধের উপসংহারে অমিতাভ গুপ্ত মতপ্রকাশ করেছেন যে, টালমাটাল ভাষা সঙ্কটের সম্মুখে বঙ্গ রাজনীতি একটি ঐতিহাসিক মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে, বিস্মৃত হলে চলবে না সওয়াশো বছরের ইতিহাস, প্রাদেশিক এবং সর্বভারতীয় রাজনীতিতে সেটি এখন নতুন ভাষ্যের প্রস্তুতিপর্বে। প্রসঙ্গক্রমে শান্তিনিকেতনের প্রতীচীতে ফিরে এসে অমর্ত্য সেন বলেছেন, বাংলা ভাষার জন্ম চর্যাপদ থেকে, তার মূল্য অপরিমেয়। এই ভাষাতেই রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলামের অমর সৃষ্টি-সম্পদ রচিত। এই ভাষায় যাঁরা কথা বলেন, তাঁদের উপর অত্যাচার হলে, অবহেলা হলে সেটি বন্ধ করা আশু প্রয়োজন।

প্রত্যেকের নিজের ভাষায় কথা বলার অধিকার অনস্বীকার্য। বাংলা ভাষার সঙ্কটকাল, দুর্দশা অতি প্রকট ভাবে প্রতীয়মান হয় সম্প্রতি ভিন রাজ্যে, এমনকি দেশের রাজধানীতেও, পরিযায়ী শ্রমিকদের উপরে অত্যাচারের ঘটনাপ্রবাহে। বাংলা ভাষায় কথা বলার জন্য তাঁরা বাংলাদেশি হিসাবে অত্যাচারিত হচ্ছেন। বাধ্য হচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে আসতে। তবে, কোনও এক সময়ে অসমে অবস্থানের কারণে কোনও পরিবারকে যখন ‘বাংলাদেশি’ হিসাবে দেগে দিয়ে ভোটার তালিকা থেকে বহিষ্কৃত করা হয়, তখন অনেক প্রশ্নচিহ্ন ওঠে।

পশ্চিমবঙ্গে কিন্তু এই তথাকথিত ‘অপর’ ভাষাগোষ্ঠীর অগণিত মানুষ কখনও বিদ্বেষের আগুনে পুড়ে ছারখার হননি। অসমের মতো কোনও রক্তাক্ত অধ্যায় পশ্চিমবঙ্গকে কলুষিত করেনি। আমার মতে এর প্রেক্ষিত অবশ্যই নবজাগরণের প্রভাব। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা ইউরোপীয় সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসার পর তাঁদের ভাব-ভাবনা, ধ্যান-ধারণার আমূল পরিবর্তন ঘটে। ভক্তিবাদের পরিবর্তে যুক্তিবাদ, বা যে ধর্মীয় আবেগে বাঙালি দৈব-নির্ভর ছিল, তারা ‘নবজাগরণ’-এর আস্থায় আত্মশক্তিকে আবিষ্কার করল। নবজাগরণের ফলস্বরূপ বাঙালি সমাজ-সংস্কারমূলক আন্দোলনে অনুপ্রাণিত হল। বিধবা বিবাহ, বহু বিবাহ রোধ, সতীদাহ প্রথা নিবারণ, স্ত্রী-শিক্ষা ও স্ত্রী-স্বাধীনতার প্রসারে জীর্ণ পুরাতন, মধ্যযুগীয় গোঁড়ামি, সাম্প্রদায়িক মনোভাব ভেঙে জাতীয়তাবোধ প্রভৃতির মধ্যে দিয়ে স্বদেশচেতনা ও দেশপ্রেমের উন্মেষ ঘটে। তাই ভাষা-চেতনার বিদ্বেষ প্রশ্রয়পুষ্ট হয়নি বাংলায়। এই ধারার ঐতিহ্যবাহী বাঙালি ভিন্ন ভাষাভাষীদের প্রতি তাই শত্রুভাবাপন্ন হতে শেখেনি।

কিন্তু রাজনীতির জটিল-কুটিল আবর্তে কী এমন অসহনীয় পরিস্থিতির উদ্ভব হল যে, বাংলাভাষী হিন্দু এবং বাংলাভাষী মুসলমানদের মধ্যে অসমে চরম বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হল? বাংলায় কথা বললেই তিনি বা তাঁরা বাংলাদেশি, অতএব, পাঠাও ডিটেনশনে? সুখের কথা, পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু-মুসলমানের সহাবস্থান শতাংশের আধিক্যের উপর নির্ভরশীল নয়। এখানেই বাঙালি-অস্মিতার প্রশ্ন ওঠে। ধর্মীয় বিভাজন ভুলে যদি সকলেই বাঙালি-জাতিসত্তার পরিচিতিকে সম্মানের সঙ্গে স্বীকার করেন, তবে সকলের মঙ্গল। পশ্চিমবঙ্গে এই মতেরই অনুসরণ দেখা যায়। সে দৃষ্টান্ত রয়েছে যেমন দিঘায় জগন্নাথ মন্দির নির্মাণে, তেমনই ফুরফুরা শরিফের উন্নয়নকল্পে সহায়তা প্রদানের মধ্যেও। রথের রশি টানা এবং ইফতারে যোগদান প্রশাসককে হিন্দু রাজনৈতিক পরিচয়ের সীমারেখায় আটকে রাখে না। বোঝা যায় অন্য ধর্মাবলম্বীরাও তাঁর প্রশ্রয় পান। এটি যদি রাজনৈতিক চমকের ঊর্ধ্বে সর্বধর্ম সমন্বয়ের উদাহরণ হয়, তা হবে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে একটি অপূর্ব ‘ঐতিহাসিক সম্ভাবনা’, যা পশ্চিমবঙ্গে সুদীর্ঘ কাল বসবাসকারী মুসলমানদের মধ্যে উদ্ভূত আশঙ্কাকে খানিকটা হলেও প্রশমিত করবে।

প্রতি দিন শয়ে শয়ে বাঙালি ভিন রাজ্যে বাঙালি পরিচয়ের কারণে অত্যাচারিত, আক্রান্ত হচ্ছেন। পরিচয়পত্র যাচাইয়ের পরও বাংলায় কথা বলার জন্য তাঁদের বাংলাদেশি বলার ঘটনা এখনও যদি আমাদের বাঙালি-অস্মিতায় ঘা না দেয়, তা হবে লজ্জার। রবীন্দ্রনাথের রাখি-বন্ধনের ঐতিহ্য শুধু একটি উৎসব নয়। সত্যজিৎ রায়-ঋত্বিক ঘটক-রবীন্দ্রনাথের গান, লিটল ম্যাগাজ়িন-চর্চার বাঙালি-কৌলীন্য নির্যাতিতদের পাশে না দাঁড়ালে, ভাগ্যতাড়িত কর্মানুসন্ধানী পরিযায়ী শ্রমিকদের অপমানে অপমানিত না হলে কিসের বাঙালি অস্মিতা? মারাত্মক অথচ যথার্থ প্রশ্নটি প্রবন্ধে উত্থাপন করেছেন লেখক। এই ‘দখলদার এলিটতন্ত্র’-কে অতিক্রম করার অস্ত্র মুখ্যমন্ত্রীর তূণে আছে কি?

ধ্রুবজ্যোতি বাগচী, কলকাতা-১২৫

একটি প্রস্তাব

ভারতীয় সংবিধানের ৩০(১) অনুচ্ছেদ ধর্মীয় ও ভাষাগত সংখ্যালঘুদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকার স্বীকৃত করে— যার মাধ্যমে তাঁরা নিজেদের পছন্দমতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনা করতে পারেন। এই অধিকার সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলিকে ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় পরিচয় বজায় রাখার ক্ষেত্রে এক প্রকার সাংবিধানিক নিরাপত্তা দেয়। তবে এই অনুচ্ছেদের কিছু দিক নিয়ে পুনরালোচনা করা যেতে পারে।

বর্তমানে ভারতে একটি সর্বজনীন ও বাধ্যতামূলক রাষ্ট্রীয় পাঠ্যক্রমের অভাব স্পষ্ট। বিভিন্ন বোর্ড, ভাষা, ধর্ম এবং আঞ্চলিক নীতির কারণে শিক্ষাব্যবস্থায় বিভাজন তৈরি হয়েছে। শিশুদের শৈশবকাল থেকেই ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শ ও তথ্যের মুখোমুখি হতে হচ্ছে, যার ফলে জাতীয় সংহতির ভিত্তি দুর্বল হচ্ছে। এই প্রেক্ষিতে কি এমন কোনও নিয়ম অনুসরণ করা যায়, যাতে সংখ্যালঘুদের সাংস্কৃতিক অধিকারও সংরক্ষিত থাকে, সঙ্গে কিছু মূল বিষয় সকল ভাষা ও বোর্ডের পাঠ্যসূচিতেই অভিন্ন ও বাধ্যতামূলক হয়?

বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়, হাওড়া

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali Education

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy