বন্ধু-দিবস উপলক্ষে স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর সুখপাঠ্য প্রবন্ধ ‘অন্ধকারের প্রতিস্পর্ধী’ (রবিবাসরীয়, ৩-৮) মনকে স্মৃতিমেদুর করে তোলে। কার্ল মার্ক্স বন্ধু হিসাবে এঙ্গেলসকে পেয়েছিলেন। শ্রীচৈতন্যের অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন নিত্যানন্দ। এখন ফেসবুকে অসংখ্য বন্ধু থাকলেও বাস্তবে কিন্তু বেশির ভাগ মানুষেরই প্রকৃত বন্ধু বলে কেউ নেই। অনাত্মীয় সব সম্পর্কই এখন যেন বড় মেকি এবং স্বার্থে ভরা বলে মনে হয়। কিন্তু প্রকৃত বন্ধু কাকে বলব? চাণক্যের শ্লোকে আছে— যে উৎসবের সময়, চরম বিপদের সময়, দুর্ভিক্ষ ও খাদ্যাভাবে, শত্রু দ্বারা পরিবেষ্টিত অবস্থায়, রাজদ্বারে, বিচারালয়ে এবং শ্মশানঘাটে সর্বদাই সহায় এবং পাশে থাকে, তাকেই কেবলমাত্র বন্ধু বলা চলে। আমার দেখা দুই পাড়াতুতো কাকার আশ্চর্যজনক বন্ধুত্বের উদাহরণটি এই সময়ে বড় প্রাসঙ্গিক মনে হয়।
গত শতকের আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। তখন গ্রামবাংলার মানুষ বিজেপি দলটির নামের সঙ্গে বিশেষ পরিচিত ছিল না। আর তৃণমূল দলের জন্ম হতেও ঢের দেরি। এই রাজ্যে তখন রাজনৈতিক দ্বৈরথ মূলত সিপিএম আর কংগ্রেসের মধ্যেই ছিল সীমাবদ্ধ। আমাদের পাড়ার সেই দুই বন্ধুর এক জন ছিলেন ঘোরতর কমিউনিস্ট। অর্থাৎ, সিপিএমের কর্মী। অপর জন অন্ধ ইন্দিরাভক্ত, কংগ্রেসের সমর্থক। সে বার গ্রাম পঞ্চায়েতের নির্বাচনে দুই বন্ধু ভোটের প্রার্থী হয়েছিলেন পরস্পরের বিরুদ্ধে। ভোটের প্রচারে তাঁরা নীতিগত ভাবে পরস্পরের রাজনীতির সমালোচনা করলেন বেশ জোর গলায়। কিন্তু তাঁদের পরস্পরকে ব্যক্তি আক্রমণ করতে শুনিনি এক বারও। তখন গ্রাম পঞ্চায়েতের নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রেই ভোট-গণনা করা হত। গণনার শেষে দেখা গেল দুই বন্ধুই সম-সংখ্যক ভোট পেয়েছেন। অগত্যা প্রিসাইডিং অফিসার টস-এর মাধ্যমে এক জনকে বিজয়ী ঘোষণা করতে বাধ্য হলেন। সেই সিদ্ধান্ত খুশি মনেই মেনেও নিলেন দুই বন্ধু। তার পর হাসিমুখেই দুই প্রতিদ্বন্দ্বী বন্ধু আলাপ-আলোচনা করতে করতে চা ও তেলেভাজা সহযোগে মুড়ি খেয়ে বাড়ি ফিরলেন।
পরে সেই বিজয়ী বন্ধু পঞ্চায়েত সমিতির গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়ে পরাজিত বন্ধুর বেকার ভাইয়ের রেশনের ডিলারশিপ-এর জন্য আবেদনে দলীয় আপত্তি অগ্রাহ্য করে অনুমোদন দেন। তখন এমনই রাজনৈতিক পরিবেশ বাংলার বেশির ভাগ গ্রামেই বিরাজমান ছিল। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব কখনও বন্ধুত্বের আলোকে নিবিয়ে নিকষ অন্ধকার করে দিতে পারত না। গ্রামে-গ্রামে সেই রকম বন্ধুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আবহ আর কোনও দিনও ফিরে পাওয়া যাবে কি?
কৌশিক চিনা, মুন্সিরহাট, হাওড়া
স্মৃতিচারণ
রবিবাসরীয়তে স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর প্রবন্ধটিতে ‘লিরিল আর বর্ণালী’র কাহিনি পড়তে পড়তে মনে পড়ে গেল আমার প্রাথমিক স্কুলের সহপাঠী বকুলদি, কাজল আর ইন্দ্রাণীর কথা। ১৯৬৬ সাল, থাকতাম দুর্গাপুরে। নিকটবর্তী প্রাথমিক স্কুলে জায়গা পাইনি। ভর্তি হলাম একটু দূরের আর একটি প্রাইমারি স্কুলে। বাসে করে যাতায়াত করতে হত। বকুলদি-কাজল থাকত তানসেন বাজারের কাছে, এক স্টপ আগে। কিছু দিন পর একটু সাহস বেড়ে গেলে, আমি স্কুলে পৌঁছনোর জন্য আগের বাসে যেতে শুরু করলাম। তানসেন বাজারে নেমে চলে যেতাম দুই বোনের বাড়ি। দরজা ঠেলে ওদের বাড়িতে ঢুকলেই দেখতাম একই দৃশ্য। ওদের মা মেঝেতে বসে একই থালা থেকে ভাত, ডাল দিয়ে মেখে খাওয়াচ্ছেন দুই বোনকে। এর পর ওদের সঙ্গে গল্প করতে করতে হেঁটে পৌঁছতাম স্কুলে। বর্ষা থেমে গেলেও যেমন অনেক ক্ষণ গাছের পাতায় সে জল লেগে থাকে, ধীরে ধীরে চুইয়ে চুইয়ে পড়তে থাকে, তেমনই বকুলদি, কাজলের সঙ্গে স্কুলে দেখা হওয়ার রেশ আমার মনে লেগে থাকত বাড়ি ফিরে আসার পরেও। এই দুই বোনের সঙ্গে আমার একটি খুব সংক্ষিপ্ত স্মরণীয় সংযুক্তি হয়েছিল, যা আজও মনে লালন করি।
তৃতীয় শ্রেণিতে বাড়ির কাছাকাছি স্কুলে ভর্তি হলাম। ইন্দ্রাণী আমার পাশে বসত। পঞ্চম শ্রেণিতে ফাইনাল পরীক্ষার ঠিক আগে, ইন্দ্রাণী তার ইংরেজি সাহিত্যের বইটি হারিয়ে ফেলেছিল। সেই সময় ইংরেজি এবং বাংলা সাহিত্যের বই শুধুমাত্র স্কুল থেকে বিতরণ করা হত এবং কোনও বইয়ের দোকানে পাওয়া যেত না। আর প্রত্যেক বছর বই পাল্টে যেত। কারণটা আমার জানা নেই। ইন্দ্রাণীর বই হারানোর অভিযোগ শুনে, শ্রেণিশিক্ষিকা জিজ্ঞাসা করেন কারও কাছে অতিরিক্ত বই আছে কি না। যখন পুরো ক্লাস নীরব, ধীরে ধীরে আমি হাত তুলে জানিয়েছিলাম যে, আমার কাছে ইন্দ্রাণীকে দেওয়ার জন্য একটি অতিরিক্ত বই আছে। যদিও আমার কাছে একটিই বই ছিল। শ্রেণিশিক্ষিকা তখন অবাক চোখে আমার দিকে তাকান। ইন্দ্রাণী তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলে যে, আমার কাছে কোনও অতিরিক্ত বই নেই। আমি ওর সবচেয়ে ভাল বন্ধু বলে ওকে সাহায্য করার জন্য আমি হাত তুলেছিলাম। শ্রেণিশিক্ষিকাও তখন ইন্দ্রাণীর বই খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত আমাদের দু’জনকে একই বই শেয়ার করতে বলেন।
ক্লাস শেষ হওয়ার পরে, ইন্দ্রাণী আমাকে বেশ ধমকই দিয়ে বলে যে, শ্রেণিশিক্ষিকা কায়দা করতে বার করতে চাইছিলেন ওর বই কে চুরি করেছে। কিন্তু বাড়তি বই দিতে চেয়ে আমি ওঁর পরিকল্পনাটাই বানচাল করে দিই। ইন্দ্রাণীর সেই ধমক আজও হুবহু মনে আছে।
লেখকের ভাষায়, ওদের সঙ্গে আর কোনও দিন দেখা হবে না। কিন্তু মনের আঙিনায় রোপণ করা সেই চারাগাছগুলি, আকারে বৃদ্ধি পেলেও, থেকে যায় মনের কোনায় সেই ছোট্ট বকুলদি, কাজল, ইন্দ্রাণী হয়েই। হারিয়ে যাওয়া ক্ষণিকের ছেলেবেলার বন্ধুত্ব মনখারাপ করায় না।
সুপ্রিয় দেবরায়, বরোদা, গুজরাত
শুধুই প্রতিদ্বন্দ্বী
বিশ্ব বন্ধুত্ব দিবস উপলক্ষে স্মরণজিৎ চক্রবর্তী রবিবাসরীয়তে যে মনোরম স্মরণালেখ্যটি লিখেছেন, সেটির দেখা বাস্তবে খুব কমই পাওয়া যায়। যেমন আমার অভিজ্ঞতা অন্য কথা বলে। ছোটবেলায় স্কুলে দেখেছি মেধাবী ছাত্ররা একে অপরের সঙ্গে মিশত না। পরীক্ষায় উত্তর বলে দেওয়া তো স্বপ্নাতীত, সব ছাত্রই অন্য জনের ত্রুটি মাস্টারমশাইকে নালিশ করে নিজের অবস্থান দৃঢ় করার চেষ্টা করত। স্কুলের খেলার মাঠটি ছিল নিম্নমেধার ছাত্রদের গালিগালাজ আর মারপিটের জায়গা। আমি ছিলাম মধ্যমেধার দলে।
এঞ্জিনিয়ারিং কলেজে বন্ধুত্ব ছিল অসম্ভব। আমরা দু’-এক জন ছিলাম বাংলা মাধ্যমের, বাকিরা ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্ৰ। তাদের প্রিয় হলিউডি সিনেমা, বিদেশি বা হিন্দি গান— সম্পূর্ণ পৃথক সংস্কৃতি। চার বছরের পঠনপাঠনের শেষ দিকে শুরু হল ক্যাম্পাস থেকে কলকাতায় ভাল চাকরি দখলের তীব্র প্রতিযোগিতা।
অবশেষে জুটল সরকারি অফিসে চাকরি এবং অফিস রাজনীতি। বন্ধুত্বের নামগন্ধ নেই, সবাই শুধুই সহকর্মী। সংগঠনবাজি। সামান্য বেচাল হলেই ‘বুলিং’ এবং আড়ালে পরচর্চা। পদোন্নতি ও কলকাতায় ভাল ‘পোস্টিং’-এর জন্য চলত দলবাজি আর রেষারেষি। মনে হত কবে অবসরের দিন আসবে?
চন্দন চট্টোপাধ্যায়, ভদ্রকালী, হুগলি
বাস চাই
কর্মসূত্রে ধুলাগড়ের কাছে আলমপুরে প্রতি দিন যাতায়াত করতে হয়। এই রুটে শ্যামবাজার-বাগনান বাস চলাচল করে। কিন্তু দেখা যায় প্রায়ই সময়মতো বাস আসে না। তা ছাড়া, এই রুটে এই একটিই বাস থাকার ফলে বাসে খুব ভিড় হয়। ফলে যাত্রীদের ভীষণ কষ্ট করে অফিসের সময়ে যাতায়াত করতে হয়। তাই, পরিবহণ দফতরের কাছে অনুরোধ, যদি একটা সরকারি বাস এই রুটে দেওয়া যায়, তা হলে খুব ভাল হয়। বিশেষত, যদি বাসের রুটটি নিবেদিতা সেতু হয়ে চলাচল করে তা হলে নিত্য অফিসযাত্রীদের কষ্ট অনেকটা লাঘব হবে।
কৃষ্ণেন্দু গুঁই, বরাহনগর, উত্তর ২৪ পরগনা
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)