E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: নৈতিকতার অভাব

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব, বাক্‌স্বাধীনতায় লাগাম, সাধারণ মানুষের প্রতিবাদকে দমন করা— এর সবই মৌলিক নৈতিকতার পরিপন্থী।

শেষ আপডেট: ১৬ মে ২০২৫ ০৬:২৯
Share
Save

কৌশিক বসু তাঁর ‘নৈতিকতার রাজনীতি’ (৯-৪) প্রবন্ধে রাষ্ট্রনীতির সঙ্গে অর্থনীতির সম্পর্কের কারণে দু’জন মহান অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ, কেনেথ অ্যারোর তত্ত্বের কথা যথার্থ বলেছেন। কোনও দেশের রাষ্ট্রনীতিতে সে দেশের উন্নয়নে বাজারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ— অর্থশাস্ত্র যে কথা বলে। উল্লিখিত দুই মহান অর্থনীতিবিদ বাজার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে যে তত্ত্বের কথা বলেছেন তা হল, যদি বাজারের মূল উদ্দেশ্য কেবলমাত্র মুনাফা অর্জন করা হয়, তা হলে অর্থব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। সেখানে বিশ্বাস ও সততার মতো নৈতিকতা ও মূল্যবোধ অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কিন্তু রাষ্ট্রব্যবস্থা চালাতে শাসক বা বিরোধী পক্ষের রাজনৈতিক নৈতিকতা খুঁজতে গিয়ে প্রবন্ধকার বর্তমান ব্যবস্থায় যেগুলি ঘটছে সেগুলি উল্লেখ করেছেন। ঘটনাগুলির সবেতেই প্রায় অনৈতিকতার ছোঁয়া। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব, বাক্‌স্বাধীনতায় লাগাম, সাধারণ মানুষের প্রতিবাদকে দমন করা— এর সবই মৌলিক নৈতিকতার পরিপন্থী।

অন্য দিকে, বর্তমানের রাজনৈতিক দল বা শাসনব্যবস্থা নিয়ে মানুষের মনে যে চরম বিতৃষ্ণা রয়েছে, তা তাদের কথাবার্তায় অত্যন্ত স্পষ্ট। আমাদের দুর্ভাগ্য, এক সময় যে ভারত নৈতিকতা ও মূল্যবোধের প্রবক্তা হিসাবে বিবেচিত হত, সেই ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোই আজ মসনদ দখলের লড়াইয়ে মেতে উঠেছে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে অবগাহন করে। শাসক বা বিরোধী পক্ষের রাজনৈতিক মানুষদের মধ্যে সাধারণ মানুষের জন্য কোনও প্রকার সহমর্মিতা বা উদ্বেগ নেই বললেই চলে। আর ঠিক সে কারণেই নৈতিক অবস্থার পুনরুদ্ধার করে সব মানুষের অধিকারের পক্ষে দাঁড়ানো সম্ভব হবে কি না, তার জন্য ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া বোধ হয় আর কোনও উপায় নেই।

স্বরাজ সাহা, কলকাতা-১৫০

জ্ঞানের আলো

কৌশিক বসুর প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। ‘রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও আমি’ শীর্ষক প্রবন্ধে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী লিখেছেন, “...তিনি বলছেন, ‘কঠিনেরে ভালবাসিলাম’, বলছেন, কেননা কঠিনকে ভাল না-বাসলে সত্যকেই অস্বীকার করা হয়। সত্য থেকে বিচ্যুতি ঘটে। এই যে শিক্ষা, আমাদের ব্যক্তিগত জীবনচর্যায় এ-শিক্ষা যতটা জরুরি, গোটা মানবসমাজের জীবনে তার চেয়েও অনেক বেশি জরুরি তাঁর ওই দ্বিতীয় শিক্ষা। দেশগত, ধর্মগত, ভাষাগত পরিচয় থেকে যা আমাদের বিচ্যুত হতে বলে না, কিন্তু সেখানে স্থিত থেকেও আমাদের মনুষ্য পরিচয়ে উত্তীর্ণ হতে শেখায়। ভাবতে শেখায় যে, সেটাই আমাদের চূড়ান্ত পরিচয়। কেন যে এটাকে আরও অনেক বেশি জরুরি শিক্ষা বলেছি, তা কারও না-বুঝবার কথা নয়। বলেছি, তার কারণ, মনুষ্য পরিচয়ে উত্তরণ ঘটবামাত্র আমরা গোটা মনুষ্য-পরিবারের সদস্য হয়ে যাই, এবং সেই পরিবারের যে কোনও সদস্যের গায়ে যে-কেউ-আঘাত হানুক না কেন, তার বেদনা তখন আমাদের বুকেও সমান তীব্র হয়ে বাজে।” (দেশ, ২-৫-১১)

সকলের বেদনা নিজেদের বুকেও তীব্র হয়ে বেজে চলার মাঝেই আমাদের মনুষ্যত্বের পথে উত্তরণ ঘটে। সুভাষচন্দ্র কিংবা জওহরলাল আর্থিক বিকাশে রাষ্ট্রের মুখ্য ভূমিকার কথা বার বার উল্লেখ করতেন প্রধানত এই কারণে যে, ব্যক্তিগত উদ্যোগে এবং বাজারের কেনাবেচার মধ্য দিয়ে যে ধরনের বিনিয়োগ সাধারণত হয়ে থাকে, তাতে সামাজিক উন্নতির চিন্তার তুলনায় কারবারের লাভ-লোকসানের চিন্তাই বেশি থাকতে দেখা যায়। অর্থতাত্ত্বিক চিন্তার আদি পুরুষ অ্যাডাম স্মিথ অবশ্য বহু মানুষের মনে এই প্রত্যয় জাগিয়েছিলেন যে শিল্পোদ্যোগীরা ব্যক্তিগত লাভের দিকে দৃষ্টি রেখেও সমাজের শ্রীবৃদ্ধি ঘটান, উৎপাদনে জোয়ার এনে সমাজে ব্যাপক পরিবর্তনের সুযোগ করে দেন। কিন্তু কালক্রমে যখন দেখা গেল যে ব্যক্তিগত উদ্যোগের ভূমিকা অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক কল্যাণের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ায়, তখন সেই অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে সমাজকে মুক্ত করা ছাড়া উপায়ান্তর দেখা গেল না। (ঋণস্বীকার: “অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও উন্নয়ন”, ধীরেশ ভট্টাচার্য, দেশ, ৯-৯-৯৭)

সমাজতত্ত্ববিদ, অর্থনীতিবিদ, ইতিহাসবেত্তা ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় মনে করতেন, ভারতের মতো দেশের সমস্যা হচ্ছে ‘সাধারণকে বড় করা— উঁচু স্তরে তোলা।’ (আমরা ও তাঁহারা, পৃ ৮৫) এমন ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার যেখানে প্রতিটি মানুষ সঙ্কীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থ অতিক্রম করে যুক্তি, বুদ্ধি ও কর্মের সাহায্যে পার্সন বা পুরুষ হয়ে উঠবে। তিনি বলতেন, ব্যক্তির মধ্যে মর্যাদাজ্ঞান নেই। সমষ্টির বা সমাজেরও এই মর্যাদা থাকা চাই। বৃহত্তর বিশ্বের সঙ্গে সংযোগে এবং লজ্জাকর পরানুকরণ ও পরনির্ভরশীলতার পরিবর্তে স্বকীয়তা ও সর্বজনক্ষমতার বোধ ও পরিচয়দানেই এই মর্যাদা প্রকাশিত। (ঋণস্বীকার: ‘সমাজতাত্ত্বিক ধূর্জটিপ্রসাদ’, স্বপনকুমার ভট্টাচার্য ও গায়ত্রী ভট্টাচার্য, দেশ, ৩-৬-৯৫)।

বর্তমান ভারতের বিভাজনের রাজনীতির প্রেক্ষিতে ধূর্জটিপ্রসাদের ভাবনাগুলি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। তিনি লিখেছেন, “মোগল-পাঠান প্রভৃতি মুসলমান বিজেতার ঋণকে আমি... তাজমহল, ফতেপুর-সিক্রী, মিঞাকি মল্লারের দিক থেকেই দেখি। শুধু তাই নয়, একত্র বসবাস করার ফলে হিন্দু-মুসলমান একটি নিখিল ভারতীয় সমাজের অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। গ্রাম্য ও গোষ্ঠীজীবনের দায়িত্ব, জাতি ও শ্রেণি বিচার, বিধবা-বিবাহ বর্জনের দোষগুণ, এবং অপার্থিব শক্তির প্রতি আস্থা দুটি ভিন্ন সমাজ-ধর্মকে একত্রিত করেছে। এই ভারতেরই জমি চাষ করে, হিন্দুস্তানের ভাষাকে অদল-বদল করে, পরিচ্ছদ আদব-কায়দা, রান্নাবান্না ও নানা রকমের মানসিক ও ধর্মসংক্রান্ত সংস্কারকে উলটেপালটে, অন্য সমাজের প্রপীড়িত মানুষদের বুকে টেনে নিয়ে পাঁচ-সাতশো বছরকার পূর্বের বিজেতার দল ভারতবর্ষের অন্য অধিবাসীদেরই মতো ভারতবাসী বলে গণ্য হওয়ার অধিকার অর্জন করেছেন।”

এক সময় সম্মিলিত এই ভারতই আন্তর্জাতিকতার বার্তা প্রচারের ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছে। আর আজ সংখ্যাগুরুর ধর্মীয় উন্মত্ততা এবং এক শ্রেণির রাজনীতির সংখ্যালঘু তোষণ জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সমূহ ক্ষতি করেছে। পরস্পর পরস্পরকে শত্রু ভেবে নৈতিকতাহীন রাজনীতিতে হিন্দু-মুসলিম ভোটের শতাংশের হিসাবনিকাশ এই দেশকে করেছে কলুষিত। সেই কারণেই ধর্মীয় গোঁড়ামি সমূলে উৎপাটিত করতে কবি বলেছিলেন: “ধর্মকারার প্রাচীরে বজ্র হানো,/ এ অভাগা দেশে জ্ঞানের আলোক আনো।”

সঞ্জয় রায়, হাওড়া

লাভ-ক্ষতি

কৌশিক বসুর প্রবন্ধে ‘নীতির অর্থ’ বুঝতে আলোচ্য লেখাটিতে দেখছি, ‘নৈতিকতার রাজনীতি’র প্রধান বিষয় দু’টি— মুনাফা ও নীতি। দেখা যাচ্ছে, মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সর্বোপরি নৈতিক অবস্থান ভেদে পাল্টে যায় নীতি ও মুনাফার অর্থ। আলোচ্য সমস্যার কেন্দ্রে দেখা যাচ্ছে, ‘নীতির অর্থ’ ও ‘অর্থের নীতি’— দুই বিষয়ে পৃথিবী জুড়ে দ্বন্দ্ব প্রতি মুহূর্তে আগের থেকে ভয়ানক হয়ে উঠছে। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই সমস্যা, ‘অর্থ’ দেশকালের রূপান্তর ভেদে বদলে যাচ্ছে। অর্থ ব্যবহারকারী মানুষও প্রতিক্ষণে পাল্টে যাচ্ছেন। মানবিকতার বিবর্তন হয়েই চলেছে। মুনাফা পরিচালনা করার ‘অদৃশ্য হাত’-এর আঙ্গিক ও চরিত্র সদা পরিবর্তনশীল। তবুও মানবিকতার দায়ে লেখকের পরামর্শ, ‘বিশ্বাস ও সততার মতো মৌলিক নৈতিকতা ও মূল্যবোধ অপরিহার্য’। কিন্তু তা মিলবে কই? কারণ, কয়েক জন অসাধু, অসৎ মানুষের অমানবিক রিপু সমগ্র মানবজাতির মধ্যে অনর্থ বাড়িয়ে যাচ্ছে। পুঁজি ও শ্রমের মধ্যে সম্পর্ক আরও দূষিত হয়ে যাচ্ছে।

দীর্ঘকাল আর্থিক ক্ষেত্রে কাজ করার অভিজ্ঞতায় সমাজে আত্মীয় বন্ধু প্রতিবেশী ‘ব্যবসায়ী’দের দেখেছি, কেউ শান্তিতে নেই। যেটুকু বুঝেছি, মূল কারণ, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ক্রম উন্নয়নে পণ্য ও পরিষেবার স্থায়িত্ব কমে যাচ্ছে। যত স্থায়িত্ব কমছে, মুনাফা কমছে। আবার যাদের অর্থ কম, সে অর্থের মূল্য প্রতি দিন কমে যাচ্ছে, জীবিকা প্রতি মুহূর্তে অনিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে। টান পড়ছে নৈতিকতায়। কারও মুনাফা কাউকে সন্তুষ্ট করতে পারছে না। অথচ সামান্য মুনাফা কম করে কিছু ফিরিয়ে দিলে পৃথিবীটা অন্য রকম হয়ে যাবে। লেখক তাই অনেক পরিতাপে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন, এ ‘আমাদের সবার লজ্জা’।

শুভ্রাংশু কুমার রায়, ফটকগোড়া, হুগলি

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Politics Economy ruling party Nationalism Governance

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে আপনার সাবস্ক্রিপশন আপনাআপনি রিনিউ হয়ে যাবে

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।