Advertisement
E-Paper

রি়জ়ার্ভ ব্যাঙ্কের নাট্যশালায়

শক্তিকান্ত দাস অতঃপর কেন্দ্রীয় সরকারের কথায় চলবেন কি না, দিনে ডাকাতির জন্য হাট করে খুলে দেবেন কি না রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের তোশাখানা, তার চেয়ে ঢের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রয়েছে

অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:২০
স্বামীনাথন গুরুমূর্তি, শক্তিকান্ত দাস ও উর্জিত পটেল

স্বামীনাথন গুরুমূর্তি, শক্তিকান্ত দাস ও উর্জিত পটেল

শক্তিকান্ত দাস অতঃপর কেন্দ্রীয় সরকারের কথায় চলবেন কি না, দিনে ডাকাতির জন্য হাট করে খুলে দেবেন কি না রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের তোশাখানা, তার চেয়ে ঢের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রয়েছে— স্বামীনাথন গুরুমূর্তি ঠিক কতখানি ক্ষমতাবান? উত্তরটা ভারতীয় অর্থনীতির পক্ষে সুসংবাদ, দাবি করার উপায় নেই। গুরুমূর্তি প্রভূত ক্ষমতাবান। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের সাম্প্রতিক সংঘাত, বিরল আচার্যের বোমা এবং শেষ অবধি উর্জিত পটেলের পদত্যাগ ও শক্তিকান্ত দাসের গভর্নর হওয়া— গত দু’মাসে দেশের শীর্ষ ব্যাঙ্কে যা যা হল, সেই ঘটনাক্রম বুঝতে হলে স্বামীনাথন গুরুমূর্তিকে না বুঝে উপায় নেই। এবং, কেন তিনি ক্ষমতাবান, সেই খোঁজ করতেই হবে।

১৯৯০-এর দশকের গো়ড়ার দিকে কোনও একটি সভায় গুরুমূর্তির বক্তব্য শুনেছিলেন জগদীশ ভগবতী। গুরুমূর্তি সম্বন্ধে তাঁর মতামত ছিল এক লাইনের— ‘‘এই ছোকরা যদি অর্থনীতিবিদ হয়, তা হলে আমি ভারতনাট্যম নাচিয়ে।’’ গুরুমূর্তি অর্থনীতিবিদ নন, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। শোনা যায়, একটি সর্বভারতীয় সংবাদপত্রের অডিট করতে করতেই সেই কাগজের প্রাণপুরুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় তাঁর, এবং গুরুমূর্তি কলামনিস্ট হয়ে ওঠেন। সেই সূত্রেই অর্থনীতির সঙ্গে যোগাযোগ। আরএসএস-এর স্বদেশি জাগরণ মঞ্চের সহ-আহ্বায়ক হিসেবে উদার অর্থনীতির প্রবল বিরোধী গুরুমূর্তি এই অগস্টে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের অন্যতম ডিরেক্টর নিযুক্ত হন। তার আগে, তাঁর মেয়ের বিয়েতে দিল্লি থেকে উড়ে এসেছিলেন অমিত শাহ, অরুণ জেটলি-সহ বিজেপির প্রথম সারির নেতারা। এবং, তারও আগে, ডিমনিটাইজ়েশনের মূল ভাবনাটা নরেন্দ্র মোদী নাকি তাঁর থেকে ধার করেছিলেন।

রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কে উর্জিত পটেলের সঙ্গে তাঁর মতের মিল হয়নি। সেন্ট্রাল বোর্ডের মিটিং দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। যাঁরা ব্যাঙ্কের অন্দরমহলের খবর রাখেন, তাঁরা বলেছেন, ব্যাঙ্ককে আরও বেশি সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার কথা বলেছেন গুরুমূর্তি। অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে টাকা দেওয়ার বন্দোবস্ত করার কথা বলেছেন, ব্যাঙ্কের উদ্বৃত্ত টাকা সরকারের হাতে তুলে দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করেছেন। উর্জিত পটেল শেষ অবধি যে দিন পদত্যাগ করলেন, সে দিন স্বদেশি জাগরণ মঞ্চের আর এক আহ্বায়ক, গুরুমূর্তির দীর্ঘ দিনের সহকর্মী অশ্বিনী মহাজন উচ্ছ্বসিত প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক ক্রমশ বিদেশি প্রভাব থেকে মুক্ত হচ্ছে। মহাজনের কথাটার গুরুত্ব নেহাত কম নয়— গুরুমূর্তির মতোই তিনিও সঙ্ঘ পরিবারের ঘরের লোক। ‘বিদেশি প্রভাব’ থেকে মুক্ত হওয়ার মানে ব্যাঙ্কের আরও বেশি নাগপুরের পথে চালিত হওয়ার সম্ভাবনা, আর সেই প্রভাবের একটা বড় উৎস স্বামীনাথন গুরুমূর্তি।

শক্তিকান্ত দাস আর গুরুমূর্তি— দু’জনের মধ্যে মিল অনেক। অর্থনীতির ছাত্র না হয়েও দু’জনেই এখন ভারতীয় অর্থনীতির কর্ণধার। দু’জনেই ডিমনিটাইজ়েশনের মুখ। প্রথম জন প্রকাশ্য মুখ, দ্বিতীয় জন অন্তরালের। এবং, যাবতীয় পরিসংখ্যান যখন নোট বাতিল নীতির ব্যর্থতা ঘোষণা করে দিয়েছে, তখনও দু’জনেই জোর গলায় সমর্থন করে গিয়েছেন সিদ্ধান্তটিকে। নোট বাতিলের বর্ষপূর্তিতে টুইট করে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন দাস। আর, এই নভেম্বরে প্রকাশ্য সম্মেলনে গুরুমূর্তি বলে এলেন, ভারতীয় অর্থনীতিকে অনিবার্য বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচিয়েছে ডিমনিটাইজ়েশন। শুধু অর্থনীতির কাণ্ডজ্ঞানের অভাব? না কি, তাঁরা মন্ত্র শিখে নিয়েছেন, ‘হীরকের রাজা ভগবান’? নোট বাতিলের ফলে যদি ভারতীয় অর্থনীতি জাহান্নমেও যায়, তাঁরা জানেন, নরেন্দ্র মোদীকে চটিয়ে লাভ নেই? দ্বিতীয় সম্ভাবনাটা এমনই প্রবল যে এই মুহূর্তে তাকে উড়িয়ে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। নোট বাতিল নিমিত্তমাত্র— আসল কথা হল, ভারতীয় অর্থনীতির রাশ এখন যাঁদের হাতে, আশঙ্কা হয়, তাঁদের কাছে অর্থনীতির স্বাস্থ্যের চেয়ে ঢের বেশি জরুরি অনুগত থাকতে পারা।

এখানেই গুরুমূর্তির ক্ষমতাবান হয়ে ওঠার মাহাত্ম্য। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে পদত্যাগ করা ইস্তক উর্জিত পটেল যে ভাবে মোদী-বিরোধীদের নায়ক হয়ে উঠেছেন, তাতে মনে হচ্ছে, তাঁরা ২০১৬ সালের নভেম্বরের কথা ভুলে গিয়েছেন বিলকুল। এই উর্জিত পটেলের আমলেই নোট বাতিল হয়েছিল। বিনা প্রশ্নে, বিনা প্রতিরোধে মেনে নিয়েছিলেন পটেল। দু’বছর পেরিয়ে তিনি ব্যাঙ্কের স্বাধিকারের প্রবলতম প্রবক্তা হয়ে উঠতেই পারেন— মন যখন তাঁর, পাল্টানোর অধিকারও বিলক্ষণ তাঁরই— কিন্তু সন্দেহ, তাঁর পদত্যাগ শুধু নীতিগত কারণে নয়। ব্যাঙ্কের রাজনৈতিক দখল নেওয়ার তাগিদ অশোক রোডে এমনই তীব্র হয়েছে যে পটেলের পক্ষেও টিকে থাকা সম্ভব হল না? নচিকেত মোর-এর বিদায়ের কথাটাও ভুললে চলবে না। আইআইএম-এ রঘুরাম রাজনের সহপাঠী মোর রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের বোর্ড অব ডিরেক্টর্স-এ ছিলেন। অর্থনৈতিক ভাবে উদারপন্থী মোরকে বিদায় করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছিল গুরুমূর্তির স্বদেশি জাগরণ মঞ্চ। অক্টোবরে শেষ অবধি বিদায় হলেন নচিকেত মোর। উদার অর্থনীতিতে বিশ্বাসীদের প্রস্থান, আর স্বদেশি জাগরণের প্রবক্তাদের উত্থান— রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের মঞ্চে যে নাটক জমে উঠছে, সেটাকে এ বার না বুঝলেই নয়।

জাগরণওয়ালাদের অর্থনীতি গোলমেলে, কিন্তু তার চেয়ে ঢের বেশি গোলমেলে তাঁদের রাজনৈতিক দর্শন। নাগপুরের পাঠশালায় যা শেখানো হয়, গুরুমূর্তিরা সেটাই শিখেছেন— কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ। পটেল থাকাকালীনই রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কে সেই আত্মসমর্পণের পালা আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল। ১৯ নভেম্বর ব্যাঙ্কের বোর্ড অব ডিরেক্টর্স-এর বৈঠকেই তার আঁচ পাওয়া গিয়েছিল। অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ঋণ পুনর্গঠন থেকে প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশনের কাঠামো পরিবর্তন, এবং সবচেয়ে বড় কথা, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের উদ্বৃত্তে কেন্দ্রীয় সরকারের দখলদারিকে ছাড়পত্র দেওয়ার প্রথম ধাপ, সবই হয়েছিল সেই বৈঠকে। অর্থাৎ, সরকার যা যা চেয়েছিল, ব্যাঙ্কের ডিরেক্টররা কার্যত মেনেই নিয়েছিলেন। তখনও উর্জিত পটেল ছিলেন ব্যাঙ্কের গভর্নর। অন্দরমহলের খবর রাখেন, এমন লোকরা বলছেন, বোর্ডের বৈঠকে ক্রমেই উচ্চতর হয়েছে গুরুমূর্তির স্বর। অনুমান করা যায়, ঠিক সেই কারণেই তাঁকে বোর্ডে মনোনয়ন দিয়েছিল সরকার। শক্তিকান্ত দাসের আমলে কী হতে চলেছে, আঁচ করে অনেকেই আতঙ্কিত।

কেন্দ্র রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে টাকা চায়। তাতে আশ্চর্য হওয়ার কোনও কারণ নেই— সরকার সব সময়ই টাকা চায়, সব দেশেই। কিন্তু, দুনিয়ার সব দেশে আর যা হয়, ভারতে সেটা হওয়ার সম্ভাবনা ক্রমে ক্ষীণতর হচ্ছে— সরকারের চাহিদায় লাগাম পরানোর জোর কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের ক্রমেই কমছে। টাকার দাম তেলমাখা বাঁশে বাঁদরের মতো পিছলে নামায় রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের হাতের উদ্বৃত্তের পরিমাণ বেড়েছে। সেই টাকার একটা বড় অংশ কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ে নিলে অর্থনীতিতে কতখানি বিপদ হতে পারে, গুরুমূর্তিরা সেই হিসেব কষবেন না। ব্যাঙ্কের হাতে যথেষ্ট টাকা না থাকলে সমস্যা অনেক। আন্তর্জাতিক বাজার টালমাটাল হলে, টাকার দাম আরও পড়ে গেলে, ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় আচমকা সঙ্কট দেখা দিলে, দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হলে— প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিবিধ কারণে ব্যাঙ্কের হাতে যথেষ্ট উদ্বৃত্ত থাকা জরুরি। আরও একটা কারণে জরুরি— ব্যাঙ্কের হাতে টাকা না থাকলে কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর তার নির্ভরশীলতা বাড়বে, ফলে ব্যাঙ্কের স্বাধীনতা কমবে। অর্থনীতির পক্ষে এর ফল মারাত্মক। ধাক্কা খেতে পারে ভারতের ক্রেডিট রেটিংও। অন্তত একটি গ্লোবাল রেটিং সংস্থা ইতিমধ্যেই সেই কথা শুনিয়ে রেখেছে।

গুরুমূর্তি-শক্তিকান্ত দাসদের আমলে এই বিপদগুলোর কথা খুব বেশি গুরুত্ব পাবে, তেমন ভরসা পাচ্ছি না। তামিলনাড়ুতে থাকার সময় শক্তিকান্ত দাস কী ভাবে জয়ললিতার চাপের সামনে অনড় ছিলেন, ফলাও খবর হচ্ছে সংবাদমাধ্যমে। খড়কুটোর ভরসা খুঁজছেন অনেকেই। পাওয়া গেলে, ভাল। নয়তো কত বড় বিপদ, সেই আন্দাজ পাওয়াও কঠিন। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের ওপর কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ এক বার মেনে নেওয়া মানে চির কালের জন্য তার স্বাধীনতাহীনতা মেনে নেওয়া। আজ বাদে কাল যদি দিল্লিতে সরকার পাল্টায়, নরেন্দ্র মোদীর জায়গায় যদি অন্য কোনও প্রধানমন্ত্রী কুর্সিতে বসেন, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ককে তার স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেওয়ার কোনও কারণ থাকবে কি তাঁরও? তিনিও কি চাইবেন না নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য মেনেই ব্যাঙ্ককে চালাতে?

আজকের স্বামীনাথন গুরুমূর্তির বদলে কাল অন্য কেউ আসবেন। কিন্তু, গুরুমূর্তিদের হাতেই ক্ষমতা থাকবে। সেটাই মারাত্মক।

(অনিবার্য কারণে এ সপ্তাহে ‘রাজনীতি’ কলামটি প্রকাশিত হল না।)

Banking Economy Finance
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy