Advertisement
E-Paper

গণতন্ত্রের এই বৃহত্তম উৎসবে গণের কী মহিমা

এই যেমন ভোট এলেই হয় আর কী! গণতন্ত্রের এই গণ-উৎসবে ভোটবাবুদের কাছে রাতারাতি ভিভিআইপি বনে যাওয়া এই ‘গণ’র এখন কী করি, কী হয় অবস্থা।

সাহাবুদ্দিন

শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০১৯ ০১:৪১
প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

দরজায় কড়া নাড়ছে ভোট আর উঠোন জুড়ে কফিন বন্দি হয়ে পড়ে আছে পুলওয়ামা-বালাকোট। কার ঘর, কার উঠোন? একশো তিরিশ কোটির। যাদেরকে ইচ্ছেমত ‘গণ’ বলে দেগে দেওয়া যায়। প্রয়োজনে গণ-ধোলাই (মগজে, না হলে দেহে)। তাতে কাজ না হলে সোজা গণ-কবর কিংবা গণ-চিতা পর্যন্ত রাস্তা দেখিয়ে দেওয়া যায়।

অপরাধ? শুধু নিজের মতকে নিজের মতো করে প্রকাশ করা। নিজের রুচি অনুযায়ী নিজের খাদ্যতালিকা ঠিক করা। কিংবা নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অন্যের চাপিয়ে দেওয়া যা কিছু, তাকে প্রত্যাখ্যান করা। কথাগুলো এই কারণেই বলা যে পথে-ঘাটে, হাটে-বাজারে হঠাৎ দেখছি এই বেচারি ‘গণ’ই তার চিরায়ত নিরীহ অবস্থান থেকে ভোটের ভরা বাজারে কেমন যেন কেষ্টবিষ্টু হয়ে উঠেছে। কার কাছে? আজ্ঞে, ভোটবাবুদের কাছে।

এই যেমন ভোট এলেই হয় আর কী! গণতন্ত্রের এই গণ-উৎসবে ভোটবাবুদের কাছে রাতারাতি ভিভিআইপি বনে যাওয়া এই ‘গণ’র এখন কী করি, কী হয় অবস্থা।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

হে আমার গণ, কে তোমায় আশা দেবে, কে তোমায় ভরসা দেবে, কে শোনাবে অভয় বাণী? মাফ করবেন, আসলে ভোটের ভরা বাজারে গণতন্ত্রের পবিত্র মন্দিরে ঢোকার ছাড়পত্র চাইছেন যে ভোটবাবুরা, তাঁদের কাছে অকস্মাৎ কল্কে পেয়ে আমার মতো তস্য ‘গণে’রও কেমন যেন বেশ একটা সিরাজউদ্দৌলা টাইপ নবাব নবাব ভাব এসে যাচ্ছে।

তা ছাড়া, বুঝতেই তো পারছেন, সারা বছর উপেক্ষা, বঞ্চনা আর অন্যের করুণাই যার বাঁচার রোজ নামচা, সে ক’দিনের এই ভোট উৎসবে একটু আহ্লাদিত হবে না তো কীসে হবে, বলুন? হাজার হোক জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য, জনগণের এই বিপুল কর্মকাণ্ডে গণই তো মূল। কাণ্ড কিংবা ডালপালা হয়ে উপরে ওঠা তার নাই-বা হল। তা ছাড়া, সে নিজে এটা ভাল মতোই জানে, ভালয় ভালয় ভোটটা মিটে গেলেই গণ আবার যে তিমিরে, সেই তিমিরেই।

হয়তো বা জানে বলেই ভোটবাবুদের কাছে তার ক’দিনের এই কল্কে পাওয়া নেহাত মন্দ লাগে না। অনেকটা সেই রঙ্গমঞ্চে কিছুক্ষণ রাজার ভূমিকায় অভিনয় করার মতো। নির্ধারিত সময় পর্যন্ত অভিনয়ের পর প্রস্থান শেষে রাজার পোশাক খুলে একাকী নির্জন পথে অসুস্থ পিতামাতা কিংবা সন্তানের অসহায় মুখ মনে করতে করতে বাড়ি ফেরা অভিনেতা। বেচারি ‘পুয়োর প্লেয়ার’!

বেচারি ‘গণে’র নির্মম নিয়তি, তাকে তার নিজের বিরুদ্ধেই খেপিয়ে তোলা যায় খুব সহজে। আর এই সহজ কাজটি সারা বছর তো বটেই, ভোটের বাজারে খুব নিপুণ ভাবে করে যান ভোটবাবুরা। তাই গণপিটুনি থেকে গণ-নিধন— সব ক্ষেত্রেই ‘গণ’র বিরুদ্ধে ‘গণ’কেই খেপিয়ে তোলার কুৎসিত রাজনীতি জগৎজোড়া। আর সেই কারণেই বোধহয় মারেও ‘গণ’, মরেও গণ।

আহা, বেচারি গণ! ভোটের ভরা বাজারে নেতার কাছে একটু কল্কে পাওয়াটা তার মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। আর মাথাটা ঘুরে গেলে তার বিষময় ফল কতটা মারাত্মক হতে পারে, তা তো প্রাক্-নির্বাচনী ও নির্বাচন-উত্তর সংঘর্ষগুলির দিকে তাকালেই দেখা যায়।

এমনকি নির্বাচনের দিন ঘোষণার ঠিক আগে আগেই পুলওয়ামায় জঙ্গিহানায় আমরা হারালাম দেশের যে বীর জওয়ানদের, তাঁরাও শেষ পর্যন্ত আমাদের মতোই সাধারণ ঘরের সন্তান। অর্থাৎ, তাঁরাও একশো তিরিশ কোটির দেশের হতদরিদ্র গণকেই প্রতিনিধিত্ব করে। তাই ঘরের দরজায় যখন কড়া নাড়ে ভোট আর উঠোন জুড়ে কফিন বন্দি হয়ে শুয়ে থাকে পুলওয়ামা, উরি, পাঠানকোট, তখন মনে হয় জঙ্গিনিধন যেমন আমাদের জাতীয় দায়িত্ব, তেমনই জওয়ানদের জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার পরিকাঠামো নির্মাণ ও তার যথাযথ ব্যবহার অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে দেখাটাও আমাদের জাতীয় কর্তব্য নয় কি?

এ প্রশ্ন গণমানসে সঙ্গত ভাবেই ওঠে আর উঠলেই গণবিপত্তি। নেপথ্যে নেতাদের নোংরা রাজনীতি গণ’র বিরুদ্ধে গণ’র মগজ এমন ভাবে ধোলাই করে যে, কোনও সঙ্গত প্রশ্ন করলেও গণ’র চোখেই গণ-দেশদ্রোহী। এমনকি, কটূক্তি থেকে রেহাই পান না জওয়ানের স্ত্রীও। প্রশ্ন তোলার জন্য প্রশ্নের মুখে পড়ে তাঁর দেশভক্তি। অথচ, যে গণ সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর দেশভক্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলে, সেই গণই কী আশ্চর্য রকম নিস্পৃহ থাকে গণ’র সামগ্রিক জীবনের মানোন্নয়ন সংক্রান্ত গণ-দাবিগুলি নিয়ে। চোখের সামনে নিরীহ সহনাগরিকের নিগ্রহ, শ্লীলতাহানি, গণপিটুনি, এমনকি, হত্যাও তাকে ভয়ঙ্কর ভাবে নির্লিপ্ত, উদাসীন রাখে। একদিকে গণ’র অতিসক্রিয়তা, অন্যদিকে তার অতি নিস্পৃহতা— শেষ পর্যন্ত গণচরিত্রের তারল্যকেই প্রকট করে।

গণ-চরিত্রের তারল্য যেমন তার সীমাবদ্ধতা, তেমনই শক্তিও। সীমাবদ্ধতা এই অর্থে যে, তার এই তারল্য তাকে সহজলভ্য করে তোলে, যার সুযোগ নেয় ভোটের বাজারের ভোটবাবুরা। সারা বছর অবমানিত থেকেও ভোটের বাজারে একটু গুরুত্ব ও স্বীকৃতি পেলেই সে নিজেকে উজাড় করে দেয় ভোটবাবুর স্বার্থে। আবার এই মানস-তারল্য তার শক্তি এই কারণে যে, এই তারল্যই তাকে ভাসমান রাখে। সে কারওর কাছে প্রশ্নহীন আনুগত্যে নিজের টিকি বেঁধে রাখে না। আর রাখে না বলেই সে কখন কোন দিকে ঝুঁকবে, তার আভাস পাওয়া কঠিন। তার মানস প্রবণতা যে কোনও মুহূর্তে বদলে দিতে পারে যে কোনও হিসাব। এখানেই তার শক্তি। একদিকে এই শক্তি, অন্যদিকে তার সীমাবদ্ধতা নিয়েই গণ’র অনন্যতা। এই অনন্য গণ’র কাছে ভোট এলেই তাই নতজানু ভোটের কারবারিরা।

যে জননী ও তাঁর সন্তানের খোঁজ কস্মিনকালেও কেউ নেননি, তাঁর কোলের বাচ্চাকে প্রায় ছোঁ মেরে কোলে তুলে আদর করার হিড়িক। কিংবা বরিষ্ঠ নাগরিক যার শারীরিক হালহকিকতের খবর কেউ রাখেন না, তাঁর হাঁটুর ব্যথা, সুগার-প্রেসার ঠিক আছে কিনা— জোড়হাতে সহাস্য বদনে জানতে চাওয়া। কিংবা দিনের বেলা মিডিয়ার সামনে কোনও প্রান্তিক গণ’র জীর্ণ কুটিরে লোক দেখানো আহার আর রাত নামলেই ফাইভ স্টার হয়ে ওঠে ভোটের বাজারের পরিচিত দৃশ্যপট। আমরা পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের একশো তিরিশ কোটি গণ আপাতত প্রাণ ভরে উপভোগ করছি এই সব দৃশ্যপট।

আর গণে’র মিছিল? সে দৃশ্য আরও করুণ। গণ নিজেও কি সব সময় জানে সে যে মিছিলে হাঁটছে তা কীসের মিছিল? তাকে প্রশ্ন করলে অনেক সময়ই উত্তর আসে, সামনের দাদা জানে। সামনের দাদাকে জিগ্যেস করলে বলে, পিছনের দাদা জানে। আর পিছনের দাদা দেখিয়ে দেয় তাকে, যে জন আছে মাঝখানে। আর যে জন আছে মাঝখানে, গণ কি আদৌ তাকে জানে?

ভোটের এই ভরা বাজারে এমনই সব প্রশ্ন আর দৃশ্যপট নিয়ে দিল্লির দিকে হেঁটে চলেছে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র। সঙ্গে নিয়ে একশো তিরিশ কোটি গণ। আহা, গণতন্ত্রের এই বৃহত্তম গণ-উৎসবে ‘গণ’র কী মহিমা!

শক্তিনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক

Lok Sabha Election 2019 Democracy লোকসভা নির্বাচন ২০১৯ গণতন্ত্র
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy