Advertisement
E-Paper

ভোটাধিকার, নোটাধিকার ও আমাদের গুটিপিসি

কত কিছুই তো গা-সওয়া হয়ে ওঠে। সে সব সরিয়ে রেখে গুটিপিসির ‘সহজপাঠ’ ফোনে নামিয়ে নিতে হবে এ বার। হাতে তো মাত্র আর কয়েকটা দিন! লিখছেন কৌশিক গুড়িয়া কত কিছুই তো গা-সওয়া হয়ে ওঠে। সে সব সরিয়ে রেখে গুটিপিসির ‘সহজপাঠ’ ফোনে নামিয়ে নিতে হবে এ বার। হাতে তো মাত্র আর কয়েকটা দিন! লিখছেন কৌশিক গুড়িয়া

শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০১৯ ০১:২৭
প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

গণতন্ত্রের মহৎ-তম (বৃহত্তম) এই উৎসবে গুটিপিসি আমাদের পথ চিনিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু ফ্লেক্স কিংবা লিফলেটের গুটিপিসি আসলে কী ও কেন সে কথা হয়তো আমরা তলিয়ে দেখার জন্য সবুর করছি না। সবুর করার প্রশ্নই নেই দু’টি কারণে। প্রথমত, প্রবুদ্ধ রাজ-রৈতিকেরা ভিন্ন ভিন্ন পন্থায় ভোটার সংগ্রহের যে কাজ জারি রেখেছেন তা অনেকাংশে তেমন জুতসই হয়ে উঠছে না, আর দ্বিতীয়ত আম-সাধারণ আত্মজীবন পরিচালনায় এতটাই নিমগ্ন যে তাঁরা মুড়ি ও মুড়কির ফারাক করাকে কিছুটা হলেও সময় নষ্ট বলে আপাতত মনে করছেন!

ফলত সামগ্রিক ভাবে ভোট যে এ জেলায় আর আসছে আসছে ব্যাপার নয়, সে যে এসেই গিয়েছে সেটা যেন গায়ে মাখতে পারছেন না অনেকেই। যদিও ‘অনেকেই’-এর পরিমাণ খুব যে গুরু-সংখ্যক তেমনটাও বলা যায় না। গুটিপিসি আসলে পলু-পোকার অবয়বধারী এক মহিলা সমাজকর্মী, তিনি স্বচ্ছ ও নির্মল মতদানের তথা নির্বাচন প্রকরণের বার্তাবাহক। এ জেলায় ইসি তাদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডার করেছেন এই পিসিমনিকে। আজকের দিনে তিনি স্মার্টও বটে, কেননা তিনিই যে ‘সহজপাঠে’র প্রবক্তা। আমার আপনার স্মার্ট ফোনে বসত ক’রে ‘সহজপাঠ-অ্যাপ’ সহজ করে দিতে পারে ভোটদানের কৌশল।

তা হলে শৈশবের সেই সহজপাঠ কি আবারও স্পর্শ-যোগ্যতার নাগাল ফিরিয়ে দেবে আমাদের, এই ভোটাধিকারের অছিলায়! প্রথম ভাগের গেরুয়া এবং দ্বিতীয় ভাগের সবুজ মলাট কি আবারও নব-বর্ষী বাঙালিকে গণতন্ত্রের অক্ষর দান করবে? মনে পড়াবে ‘দিনে হই একমতো, রাতে হই আর। / রাতে যে স্বপন দেখি মানে কী যে তার!’ কিংবা ফিরে পড়তে হবে ‘ঘন মেঘ বলে ঋ / দিন বড়ো বিশ্রী।’...

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

আমরা গণতন্ত্রের সু-সম্পন্নতা প্রত্যাশা করি, কষ্ট হলেও কল্পনা করতে পারি দেশের এই উৎসবে দশও যেন অবলীলায় অংশী হতে পারে।

রাস্তায় প্রায়ই দেখা হয় এক অর্ধ-বয়সী ভবঘুরের সঙ্গে। সম্ভবত তাঁর পদবি রায়। পেট ও বুক যেখানে মিশেছে, সেই দ্রাঘিমায় তাঁর লুঙি বাঁধা থাকে। ফলত গোড়ালি পেরিয়ে প্রায় হাঁটু অব্দি দেখা যায় ভদ্রলোকের। জিজ্ঞেস করলাম ‘ভোট দেবেন?’ এদিক-ওদিক খানিক তাকিয়ে, যেন খুব ভয় জড়ানো গলায় বললেন, ‘দশটা টাকা হবে?’

অন্য দিনের মতো আজও না হয় দেওয়া গেল তাকে। কিন্তু কী বুঝতে চাই আমরা, সম্ভবত লালবাগের এক কালের এই সরকারি কর্মী মস্তিষ্ক-বিড়ম্বণায় জেলা শহরের পথঘাটকেই আপন করে নিয়েছেন। তাঁর কাছে পর হয়ে উঠেছে পরিবার, উদ্বায়ী হয়ে গিয়েছে সমাজ, আর ভোটাধিকার? উদাসীনতার বেড়া টপকে কবেই সে হয়ে গিয়েছে অস্তিত্বহীন। মাঝে মধ্যে ছেঁড়া তার জোড়া লাগলে যেমন বর্ষণমুখর রাতেও ফ্যানের ব্লেড সাময়িক ঘোরে, তেমনি ভদ্রলোকেরও মাঝে মধ্যে খবরের কাগজ পড়ার বাতিক পেয়ে বসে। সে সময় বেশ কথা বলেন তিনি। বাকি সময় ঘোলাটে চোখ এবং এক সুঠাম-উদাসীনতা। সমাজের প্রতি এও কি ভোটাধিকারের মতোই কোনও আবেগ, নাকি এ আসলে অনুসিদ্ধান্তে রেখে আসা এক ধরনের ‘নোটাধিকার’!

শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা কেসি পালের ছাতা নেই তাঁর। পরিবর্তে আছে মলিন হরিণ-রঙের একটি চাদর। তিনি শ্রী গৌর পরামানিক। রানিনগর শেখপাড়া বাজারেই তাঁকে পাবেন। শোনা যায়, বছর তিরিশেক আগে এক অপ্রাসঙ্গিক পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। বিএসএফ এসে ছত্রভঙ্গ করেন দুষ্কৃতীদের। হয়তো ভুলবশত মাথায় আঘাত পান গৌর। আজও সারা বছর চাদর মুড়ি দিয়ে নিজের মনে বিড়বিড় করেন তিনি, মাঝেমাঝে অসম চিৎকার...

ভোটের কথা শুনে তিনি যেন অস্বস্তি বোধ করলেন, অবশ্য তিনি সে-সব বোঝাবুঝির মাত্রায় আছেন কি না উপলব্ধি করার আগেই সরে পড়লেন গৌর। দেশের নির্বাচন নাকি ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন, কোনটা যে বেশি জরুরি তা ভাবতে ভাবতেই হুজুগের মতো বাস ঢুকে পড়ল বাজারে।

জিয়াগঞ্জ স্টেশনের একটু আগে আলাপ হল নজরুলের সঙ্গে। শীর্ণ লাঠি ও ততধিক শীর্ণ শরীর তাঁর সিগনেচার। জানা গেল ভিক্ষা-বৃত্তিও সংসার পালনের হাতিয়ার হতে পারে। ভাবলাম, ভোট ভিক্ষাও কি তাই? ব্যালট ইউনিট, ভোটিং ইউনিট এবং ভিভিপ্যাট ঘুরে যে মায়া জমে উঠবে মেমারিতে তাঁর মেদ নজরুলের গায়ে কেন লাগল না! কথায় কথায় তিনি জানালেন, এ বার ভোট তিনি দেবেনই। উৎসব এবং অধিকার যেন এভাবেই গার্হস্থ্য করে আজীবন।

ছিপছিপে এক বৃষ্টির দিনে তাঁকে প্রথম দেখি। ফাঁকা একটি ট্র্যাফিক দ্বীপে উঠে পড়েছেন এক মহিলা। রাস্তায় বড়জোর দু’একটা সাইকেল তখন। তারই মধ্যে হাত নেড়ে বিবিধ মুদ্রায় ট্র্যাফিক সামলানোয় ব্যস্ত! পরে বহু বার দেখা হয়েছে, সারা গায়ে শ্বেতী, বলা যায় অর্ধ উলঙ্গ, বলা যায় অভিমানী ও রাগী। মনে হয় সমাজ তাঁকে ঠকিয়েছে একাধিক বার। তিনি ঠিক পাগল নন, শরীরে-অবয়বে পাগলামি তাঁকে ছুটিয়ে বেড়ায়। প্রতিদিন বাসস্ট্যান্ডে একটি মন্দিরে তিনি যেন কী সব জানান উপরওয়ালাকে। আগ্রহ নিয়ে এক দিন বললাম, ‘দিদি তোমার নাম কী গো?’, ‘তবে রে’ বলে রাস্তা থেকে ইট, কাঠ কুড়িয়ে, থুতু ছিটিয়ে তেড়ে এলেন তিনি।

মনে হল, আমি ঠিক আক্রান্ত হয়নি, আক্রান্ত হয়েছে আমাদের গণতন্ত্র। আক্রান্ত হয়েছে শুভ ও অশুভ বুদ্ধির আঁতাত। আঁতাতের আঁচ অনেকাংশে ভোঁতা করে দেয় উৎসবের ধার।

কত কিছুই গা সওয়া হয়ে ওঠে। সে সব সরিয়ে রেখে গুটিপিসির ‘সহজপাঠ’ ফোনে নামিয়ে নিতে হবে এ বার। হাতে তো আর কয়েকটা দিন!

Lok Sabha Election 2019 Democracy লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy