১৭৬৯-এর ২২ ডিসেম্বর অসমের একটি পুরুষ গন্ডার কলকাতা বন্দর থেকে ফ্রান্সের উদ্দেশে রওনা দিল। চন্দননগরের ফরাসি গভর্নর জঁ বাপতিস্ত শেভালিয়ের ফ্রান্সের রাজা পঞ্চদশ লুইকে পশুটি ভেট পাঠিয়েছিলেন। তখন সুয়েজ় খাল ছিল না। তাই, দীর্ঘ কয়েক মাস সমুদ্রযাত্রার পর ১৭৭০-এর ১১ জুন পশুটি ব্রিটানি পৌঁছয়। ফ্রান্সের ভিতরে যাত্রাও সমান কঠিন ছিল, কারণ অত বড় পশুর উপযুক্ত যান বন্দরে ছিলই না। সেখানেই বেশ কয়েক সপ্তাহ রইল, তত দিনে যান তৈরি হল যাতে চেপে ৪৫০ কিমি পূর্বে ভার্সাইয়ের প্রাসাদে যাওয়া যায়। রাজদরবারে এসে তারকা হয়ে ওঠে গন্ডারটি। রাজপশুশালে আটকানো থাকত একা, ছোট্ট জলাশয়ের পাশে। খেত রুটি, শক্ত চামড়ায় নিয়মিত তেলমালিশ চলত। তবুও নতুন পরিবেশে খুশি হয়নি, বেষ্টনীতে প্রবেশ করায় দুটো লোককে মেরে দিয়েছিল। পশুটি ভার্সাইতে ছিল ২২ বছর। কালক্রমে তার মালিক হন রাজার নাতি, ষোড়শ লুই। ফরাসি বিপ্লবের পর সন্ত্রাসের রাজত্বের সময়, ১৭৯৩-এ গন্ডারটির পেটে তরোয়াল ঢুকিয়ে হত্যা করা হয়। এর পর প্যারিসের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজ়িয়মে এই বহুমূল্য প্রাণীটিকে স্টাফ করে সংরক্ষণ করা হয়। হাজারো মানুষের আকর্ষণ হয়ে ওঠে সেটি। সেই ১৭৭০-এর পর এই প্রথম প্যারিস ছাড়ছে প্রাণীটি। চলেছে লন্ডন। সেখানে সায়েন্স মিউজ়িয়মে ভার্সাই বিষয়ক প্রদর্শনীতে থাকবে সে। মানুষজন এসে দেখবেন চমৎকার প্রাণীটিকে, যে শত শত বছর আগে সাগর পেরিয়ে বাংলা থেকে প্যারিসে গিয়েছিল, রাজদরবারের নয়নমণি হয়ে উঠেছিল।
ঐতিহাসিক: প্রদর্শনীতে সজ্জিত অসমের গন্ডার।
ঐতিহাসিক: প্রদর্শনীতে সজ্জিত রত্নখচিত ছোরা।
হিরের চামচ
সায়েন্স মিউজ়িয়মের পাশেই ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজ়িয়মে অন্য এক প্রদর্শনী মোগল দরবারের ঐশ্বর্য দেখার সুযোগ দিচ্ছে। মোগল সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগে আকবর, জাহাঙ্গির ও শাহজাহানের আমলে শিখরে পৌঁছেছিল সৃষ্টিশীলতা। প্রদর্শনীতে সাজানো সে সময়ের নকশাদার পাণ্ডুলিপি, কারুকার্যখচিত গয়না, জেড পাথরের উপর হস্তশিল্প, চকচকে ভোজালি, তরোয়াল, পোশাক। দর্শককে নিয়ে যায় মোগল শিল্পের দুনিয়ায়, যা পারস্য থেকে ভারতে এসে স্বতন্ত্র শৈলীর জন্ম দিয়েছিল। রয়েছে চুনি ও হিরে বসানো চামচ, জেড পাথরে তৈরি শাহজাহানের সুরাপাত্র, তাঁর লৌহবর্ম। অধিকর্তার কথায়, অন্যান্য দেশে যে শিল্পবস্তুগুলির বিপদ হতে পারে, সেগুলি সংরক্ষণই জাদুঘরের কর্তব্য। কোন দেশের কথা বলছেন তিনি, ইঙ্গিত স্পষ্টই।
রহস্যময় যাত্রী
‘টু আউট’। ১৯৪৩-এর ১৬ জুন রাতে লগবুকে রহস্যময় দু’টি শব্দ লেখেন ফ্লায়িং অফিসার ফ্র্যাঙ্ক ‘বানি’ রিমিলস। ‘টু’ বলতে নুর ইনায়েত খান ও আর এক গুপ্তচর। বিমানের যাত্রী হওয়া সত্ত্বেও পাইলটকে এঁদের নাম জানানো হয়নি, চরম গোপনীয়তার স্বার্থে। সেই লগবুক ও নুরকে প্রদত্ত জর্জ ক্রস লন্ডনের রয়্যাল এয়ার ফোর্স মিউজ়িয়মে রাখা হয়েছে। নুরের পরিবার জর্জ ক্রসটি ধার দিয়েছে। প্রদর্শনীর উদ্বোধন করতে নেদারল্যান্ডস থেকে এসেছিলেন নুরের ৯৭ বছর বয়সি তুতো ভাই শেখ মেহমুদ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গুপ্তচর নুর ব্রিটেনের বীরাঙ্গনাদের অন্যতম। জার্মানিতে দাখাউ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে গুলি করে মারা হয়েছিল তাঁকে।
বীরাঙ্গনা: প্রদর্শনীতে নুরের প্রতিকৃতি।
শ্রদ্ধাঞ্জলি
গত মাসে দু’টি গির্জার অভ্যন্তর ভরে উঠল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায়। দুই ইংরেজের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় পড়া হল এই পঙ্ক্তিগুলি। ভারতের খুব কাছের মানুষ ছিলেন তাঁরা। ৭৩ বছর বয়সি উইলিয়াম রাদিচে ছিলেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে সুপণ্ডিত। কেমব্রিজে সেন্ট জন দি ইভ্যাঞ্জেলিস্ট চার্চে তাঁর পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন হল, সেখানে পাঠ করা হল রাদিচের নিজের অনুবাদ করা গীতাঞ্জলির তিনটি কবিতা। অন্য দিকে, ৮০ বছর বয়সি ডেভিড পেজ-এর অন্ত্যেষ্টি অনুষ্ঠিত হল সাউথ লন্ডনের ওয়েস্ট ডালউইচের অল সেন্ট’স চার্চে। বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস-এর ইস্টার্ন সার্ভিসেস-এর প্রাক্তন কর্তা ছিলেন তিনি। কর্মজীবনে ছিলেন ভারত-ঘনিষ্ঠ ও আজীবনের রবীন্দ্র-অনুরাগী হিসাবে সুপরিচিত। তাঁর বহু দক্ষিণ এশীয় সহকর্মী উপস্থিত হয়েছিলেন এ দিন। বন্ধুরা পড়লেন, “মোর লাগি করিয়ো না শোক”। সমাগতদের চোখ ভরে উঠল জলে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)