Advertisement
E-Paper

মুক্তি হল ভালবাসার

যুগ যুগ ধরে একে অপরের চোখে চেয়ে প্রেমার্ত মানুষ বলে এসেছে। আমাকে জেনে, বুঝে, আমার ভিন্নতাকে মেনে নিয়ে গ্রহণ করো আমাকে। আমি তোমার, কিন্তু আমি তুমি নই। 

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:০০

একটি বাক্য। যেন এক গণ্ডূষ জল। ‘‘আমি যা, আমি তা-ই, তেমন করেই গ্রহণ করো আমাকে।’’

এ যে ভালবাসার কথা, আত্মনিবেদনের কথা। যুগ যুগ ধরে একে অপরের চোখে চেয়ে প্রেমার্ত মানুষ বলে এসেছে। আমাকে জেনে, বুঝে, আমার ভিন্নতাকে মেনে নিয়ে গ্রহণ করো আমাকে। আমি তোমার, কিন্তু আমি তুমি নই।

আর শুনেছে, ‘‘ইয়ার্কি নাকি? আমার বৌ আমার মা-বোনের মতো হবে না?’’ ‘‘আমার ছেলে হয়ে অন্য ছেলের সঙ্গে ইয়ে-টিয়ে করবে?’’ ঘর ছাড়িয়ে উঠোনেও তাই। ‘‘পাড়ায় থাকো, তা বলে বাড়িতে এসে উঠবে নাকি? বাসনপত্র ছোঁয়া যাবে না?’’ উঠোন থেকে রাষ্ট্রের জমিতেও সেই খরখরে দৃষ্টি, খ্যানখেনে গলা। ‘‘ভিনধর্মের মেয়ের দিকে চোখ? উপড়ে রেখে দেব।’’

নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছি লাঠিটা সোজা, জলে ডোবালেই যেন বেঁকে যাচ্ছে। তেমনই মনের মধ্যে যা সহজ, সরল সত্য, অন্যের সঙ্গে আমার যে সংযোগ স্বাভাবিক, সুন্দর বলে অন্তরে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, সবার মধ্যে প্রকাশ করলে তা হয়ে যাচ্ছে বিকৃত, বিচ্যুত। কঠিন কণ্ঠে প্রশ্ন আসে, এতগুলো লোক কি ভুল বলছে? সমাজ যাকে অপরাধ বলছে, তা কি কখনও নির্দোষ হয়? তোমার মনে হলেই হল? তুমি কে হে? ক’জন তোমার মতো?

বড় কষ্ট হয়। বেসুরে গান গাওয়ার, বেতালে তাল দেওয়ার কষ্ট। নিজ নিবাস, মৌজা, রাজ্য, পিন কোড যার মুখস্থ, সে-ও সারা জীবন নিজের খোঁজ পায় না। আজ তারা শুনল, তোমার যা ব্যক্তিস্বরূপ, তাকে তুমি অস্বীকার করবে কী করে? তোমাকে গ্রহণ না করাই অপরাধ, তোমার দোষ নেই।

‘‘আমি যা আমি তা-ই। তেমন করেই গ্রহণ করো আমাকে’’, জার্মান কবিকে উদ্ধৃত করে বলেছেন দেশের প্রধান বিচারপতি। দেশের শীর্ষ আদালত বলে দিয়েছে, ব্যক্তির ইচ্ছেকে সম্মান করাই স্বাধীনতার আসল কথা। ‘‘তুমি কেন সবার মতো হবে না, কেন তুমি আমার মতো নও’’, এ প্রশ্ন ভ্রান্ত, এ দাবি অপরাধ।

কী আনন্দ, কী আনন্দ, কী পরম মুক্তি। শুধু কি আর সমকামী, রূপান্তরকামীদের জন্য? তাঁরা যে চোরের মতো লুকিয়ে থাকার থেকে, অশ্লীল গালি আর চোখরাঙানি থেকে নিষ্কৃতি পেলেন, সে একটা মস্ত স্বস্তির কথা তো বটেই। এ হল ভালবাসার মুক্তি। নিজের ইচ্ছেয় ভালবাসার আগল ভাঙল। এই রায় বলছে, ব্যক্তির ‘চয়েস’কে মানাতেই সমাজের মঙ্গল, সেটাই সমাজের উদারতার লক্ষণ।

এ কেবল যৌনতার মুক্তিও নয়। যৌনতার বৈচিত্রকে স্বীকৃতি দেওয়া অবশ্যই জরুরি হয়ে উঠেছিল। আরও কিছু দিন সমকাম-বিরোধী ৩৭৭ ধারা জারি থাকলে ভারত বিশ্বের ‘জুরাসিক পার্ক’ হয়ে উঠত নির্ঘাত। পচাগলা আইন বহু আগে সংসদের বাতিল করার কথা। সাংসদেরা ঝামেলা এড়াতে ঝাঁটাটি ধরিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের হাতে। আদালত কিন্তু দেশকে দিয়েছে এক বাতিঘর। যৌন আচরণের ভালমন্দ নিয়ে ঝগড়া করে যাঁরা কূল পাচ্ছেন না, তাঁদের পথ দেখাচ্ছে ওই আলো, ‘‘বেঁচে থাকা, ভালবাসার সহজ অধিকার আছে মানুষের।’’

মুক্তি পেল ব্যক্তিমানুষ। সমাজের গাঁথনিতে ব্যক্তি একটি ইট, তার স্খলন মানেই হুড়মুড় করে সমাজ-সংসার ভেঙে পড়া, অতএব নিজে চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়েও সমাজকে ধরে রাখতে হবে, এই হল প্রচলিত বিশ্বাস। সুপ্রিম কোর্ট বলছে, ভিন্ন জীবন, ভিন্ন চরিতার্থতার সন্ধান করার অধিকার রয়েছে সমাজের অতি ক্ষুদ্র কোনও অংশের। এই ভিন্নতাকে রক্ষা করাই রাষ্ট্রের কাজ। কিন্তু দেশের অধিকাংশ লোক যদি তাকে ‘অনৈতিক’ মনে করে? তাতে কিস্যু যায় আসে না, কারণ ভিন্নতাকে স্বীকৃতি দিয়েছে সংবিধান। ‘কনস্টিটিউশনাল মরালিটি’ বা সংবিধানজাত নীতিকে প্রাধান্য দেবে রাষ্ট্র, সমাজের মতকে নয়। নরেন্দ্র মোদীর যে রাষ্ট্রযন্ত্র, রায়ের এই অংশ তার মর্মস্থলে আঘাত করে।

এই রায়ে মুক্তি পেল প্রাইভেসি। যা ঠিক ‘গোপনীয়তা’ নয়, ব্যক্তিপরিসর। আমি কী রান্না করছি, কী কিনছি, শোবার ঘরে কী করছি, তা আমারই সিদ্ধান্ত। তাতে হাত দেওয়ার কাজটা কত অশ্লীল তার সাক্ষ্য বাস্তব-নির্ভর ছবি ‘আলিগড়’ (ছবিতে একটি দৃশ্য), যেখানে এক সমকামী অধ্যাপক আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন। সুপ্রিম কোর্ট প্রাইভেসিকে আগেই ‘মৌলিক অধিকার’ বলেছিল। এ বারে স্পষ্ট, ধর্মও নাক গলাতে পারে না।

এই রায়ে ফের মুক্তির বার্তা পেল মেয়েরা। দলিতরাও। এ দেশের লোকে সন্ত্রাসবাদীকে, ডেঙ্গির মশাকে, দু’হাজার টাকার নোট বাতিল হওয়াকে যত না ভয় পায়, তার চাইতে ঢের বেশি ভয় পায় একটি সম্ভাবনায়, মেয়ে যদি বেজাতে, ভিনধর্মে বিয়ে করে? যদি বিয়ের আগেই যৌনসম্পর্কে যায় প্রেমিকের সঙ্গে? তার জন্য বালিকার বিয়ে, তার জন্য পণবন্দি জামাই। তার জন্য উঁচু জাতের মেয়ে নিচু জাতের ছেলেকে বিয়ে করলে দলিত-হত্যা। গড়ে বছরে হাজারখানেক তো পুলিশের খাতাতেই লেখা হয়। গত মে মাসেই কেরলের কোট্টায়ামে মিলেছে তেইশ বছরের কেভিন জোসেফের দেহ, চোখ খোবলানো, সারা দেহে ক্ষতচিহ্ন। বিয়ের পরে সপ্তাহও কাটেনি। দলিত প্রেমিকের চোখ খুবলে না নিলে ভারতীয়ত্বের প্রমাণ নাকি থাকে না। লাভ জিহাদ থেকে অ্যান্টি-রোমিয়ো স্কোয়াড, ফের সব বাতিল করে আদালত বলল, যেখানে সম্মতি, সেখানেই সম্মান। এর অন্যথা করতে পারে না সমাজ। রাষ্ট্র।

ভিন্নকে আপন করার অধিকারে শিকড় শক্ত হয় সমাজ আন্দোলনেরও। সমকামী আন্দোলনের কর্মী সুমিতা বীথি বলেন, ‘‘আমি তো কেবল যৌন-আমি নই। দলিত আমি। মুসলিম আমি। খাদানে যে মার খায়, পণের প্রতিবাদ করলে যে বধূকে পুড়িয়ে মারা হয়, উত্তর-পূর্বে সামরিক বাহিনীর দ্বারা যে মেয়ে ধর্ষিত, সে-ও আমি।’’ সাফল্যের উদ্‌যাপনেও তাঁর চিন্তা— সমকামিতাকে অপরাধ বানানোর আইন আজ অবৈধ হল, কিন্তু বৈধ আইনের অন্যায় প্রয়োগ করে এই একাত্মতার প্রকাশ রোখা হচ্ছে যে? কখনও রাষ্ট্রদ্রোহিতা, কখনও শান্তিভঙ্গ, কখনও ধর্মবিদ্বেষের ধারা দিয়ে ভিন্নমত ব্যক্তিদের কয়েদ করছে রাষ্ট্র। মানুষের প্রতি মানুষের সহজ ভালবাসা, স্বাভাবিক সহমর্মিতাকে কেন ভয়ানক বিপদ মনে হচ্ছে রাষ্ট্রের?

মেয়ের সঙ্গে মেয়ের প্রেম করা, বা দলিত ছেলেকে ব্রাহ্মণ মেয়ের প্রেম করার মতোই?

Gay Love Supreme Court LGBT
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy