প্রতিশ্রুতি: ২০১৪ সালে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্পের সূচনায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং তৎকালীন বাণিজ্য ও শিল্প প্রতিমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন
অরবিন্দ পানাগড়িয়া নীতি আয়োগ থেকে বিদায় নেওয়ার ঠিক আগে একটি মোক্ষম বোমা ফাটিয়ে গেলেন। জানালেন, আয়োগের এক ব়ড় সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, শিল্পে সুদিন এখনও দূর অস্ত্। অর্থাৎ, প্রধানমন্ত্রী যতই ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’-র জয়ধ্বনি করুন, ওটা এই জমানার আর পাঁচটা কাগুজে বাঘ, থুড়ি সিংহের, মতোই।
নরেন্দ্র মোদীর এই মহাযজ্ঞ আসলে চিনের নির্মাণ শিল্পের সাফল্যকে অনুকরণ করার চেষ্টা। মুশকিল হল, সেই চিনও নেই, আর সেই অর্থনীতিও নেই। নির্মাণক্ষেত্রে চিন যখন চোখধাঁধানো সাফল্য পেয়েছিল, তখন বিশ্ব অর্থনীতি প্রতি দিন আড়েবহরে বাড়ছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিমাণও ক্রমবর্ধমান। চিনের পরিকাঠামো এবং সস্তা শ্রম প্রথম বিশ্বের বহুজাতিক সংস্থাগুলির সামনে উৎপাদন খরচ কমিয়ে আরও বেশি লাভ করার এক সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয়। বেশির ভাগ বহুজাতিক সংস্থা তাদের উৎপাদনের কাজ সরিয়ে আনে চিনে। চিন হয়ে ওঠে বিশ্বের অন্যতম প্রধান ‘ম্যানুফ্যাকচারিং হাব’।
কিন্তু, ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের পরে দুনিয়া জুড়েই অর্থনীতি কার্যত থমকে রয়েছে। মন্দার আগে যে বৃদ্ধির হার ছিল, প্রায় এক দশক কেটে যাওয়ার পরও তার ধারে কাছে ফিরে আসতে পারেনি গোটা দুনিয়া। অর্থাৎ, বিদেশে রফতানি করে নিজের দেশের উৎপাদন ক্ষেত্রে বৃদ্ধি ঘটানো খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঠিক এই সময়, ২০১৪ সালে, নরেন্দ্র মোদী স্থির করলেন, চিনের উৎপাদন ক্ষেত্রের সাফল্যের ফরমুলা তিনি ভারতে ‘কপি-পেস্ট’ করবেন। অর্থনীতিবিদদের একাংশ তখনই বলেছিলেন, এটা ভিত্তিহীন উচ্চাকাঙ্ক্ষা। কিন্তু নতুন সরকারকে ঘিরে তখন আশাবাদ তুঙ্গে, ফলে সেই সব আপত্তি বা আশঙ্কা বিশেষ পাত্তা পায়নি। প্রায় তিন বছর হয়ে গেছে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্পটি ঘোষণার পরে। এখন দেখা যেতেই পারে, ঠিক কী পাওয়া গেল।
কিন্তু, তার আগে দেখা ভাল, সরকার এই প্রকল্পের মাধ্যমে ঠিক কী কী করতে চেয়েছিল। প্রকল্পের সরকারি ওয়েবসাইট বলছে, লক্ষ্যগুলির মধ্যে ছিল— ক) ২০২২ সালের মধ্যে দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে উৎপাদন ক্ষেত্রের অবদান ২৫% করে ফেলা (প্রসঙ্গত, চিনে এই অনুপাত ৩০ শতাংশের আশেপাশে); খ) ২০২২ সালের মধ্যে উৎপাদন ক্ষেত্রে ১০ কোটি নতুন কর্মসংস্থান; গ) বিদেশি পুঁজির জন্যে অর্থনীতির নানা ক্ষেত্র আরও মুক্ত করা; ঘ) ভারতীয় অর্থনীতিতে অতিরিক্ত অভ্যন্তরীণ পুঁজি তৈরি; ও ঙ) এ ভাবে ভারতকে উৎপাদন ক্ষেত্রে ‘গ্লোবাল হাব’ করে তোলা।
কত দূর এগোনো গেল?
২০১৩-১৪ আর্থিক বছরে ভারতের জিডিপি-তে উৎপাদন ক্ষেত্রের অবদান ছিল ১৭ শতাংশের কাছাকাছি। লক্ষ্য ছিল, ৮ বছরে ৮ শতাংশ-বিন্দু বাড়ানো হবে এই হার। তা হলে, আট বছর পরে ২০২২ সালে তা জিডিপি-র ২৫ শতাংশে পৌঁছোবে। গত তিন বছরে জিডিপি-তে উৎপাদন ক্ষেত্রের অবদানের পরিমাণ বেড়ে ১৮ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছেছে। তবে, সরকার নিজেদের জন্য সময় বাড়িয়ে নিয়েছে। ২০২২ নয়, ২৫ শতাংশে পৌঁছোনোর জন্য ২০২৫ সালের লক্ষ্য স্থির হয়েছে।
কর্মসংস্থানের হিসেব আরও মারাত্মক। আট বছরে মোট ১০ কোটি অতিরিক্ত কর্মসংস্থান করতে হলে বছরে গড়ে সওয়া কোটি নতুন চাকরি তৈরি করতে হয়। লেবার ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৭ সালের জানুয়ারির মধ্যে উৎপাদন ক্ষেত্রে নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে মাত্র ৯৫,০০০। এই পরিসংখ্যান নিয়ে অবশ্য তর্ক আছে। নীতি আয়োগের প্রধান পদে থাকাকালীন অরবিন্দ পানাগড়িয়া আপত্তি জানিয়ে বলেছিলেন, লেবার ব্যুরো যেহেতু অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের হিসেব রাখে না, ফলে প্রকৃত কর্মসংস্থানের পরিমাণ এই পরিসংখ্যানের চেয়ে বেশি। কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রীও বলেন, কর্মসংস্থান বেড়েছে, কিন্তু পরিসংখ্যান সংগ্রহের যথার্থ পদ্ধতি না থাকায় তার হিসেব পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁদের এই যুক্তির পাল্টা আসে বেসরকারি পরিসংখ্যান সংস্থা সিএমআইই-এর কনজিউমার পিরামিড সার্ভের ফলাফলে। দেখা যায়, ২০১৭ সালের প্রথম তিন মাসে সারা দেশে ১৫ লক্ষ কর্মসংস্থান কমে গেছে। কাজেই, এটা বলা যেতেই পারে যে গত এক বছরে বিপুল নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে, এমন দাবির পক্ষে কোনও তথ্যপ্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি। কিন্তু, দেশে যে সার্বিক ভাবে কাজের অভাব ঘটেছে, তার প্রমাণ আসতে শুরু করেছে।
গত দিন বছরে বিদেশি পুঁজির জন্য নানান ক্ষেত্রের দরজা খোলা হয়েছে, এটা ঠিকই, কিন্তু সেই দরজা গলে এখনও অবধি ততখানি বিদেশি পুঁজি আসেনি যা দিয়ে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রকল্পকে সফল করা যেতে পারে। তা ছাড়া, বিদেশি পুঁজির সিংহভাগ এসেছে নানান সংস্থার ইক্যুইটিতে, নতুন প্রকল্পে নয়। কাজেই, বিদেশি পুঁজির জোরে দেশের উৎপাদন ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটানো এখনই সম্ভব হচ্ছে না।
দেশের অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের হালও ভাল নয়। জিডিপি-র শতাংশের হিসেবে দেশে কতখানি অভ্যন্তরীণ পুঁজি তৈরি হচ্ছে, তা বিনিয়োগের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মাপকাঠি। ২০১১ সালের জুন মাসের পর থেকে এই অনুপাত শুধুই কমেছে। ২০১১ সালের জুনে এই পুঁজি তৈরি হওয়ার পরিমাণ ছিল জিডিপি-র ৩৫.৪ শতাংশ। ২০১৭ সালের মার্চে অনুপাতটি কমে ২৮.৫ শতাংশ হয়ে গেছে। উৎপাদন ক্ষেত্রে শিল্পোৎপাদনের সূচকের (আই আই পি) বৃদ্ধির হার ২০১৩-১৪ সালের -০.৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১৫-১৬ সালে এসে ২.০ শতাংশ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ২০০৭-০৮ সালের ১৮.৪ শতাংশ বা ২০১০-১১ সালের ৯ শতাংশের ধারে কাছেও পৌঁছতে পারেনি। আরও একটি পরিসংখ্যান জানিয়ে রাখা যাক। ২০১৬-১৭ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর, এই তিন মাসে ভারতের শিল্পক্ষেত্র তার মোট উৎপাদন ক্ষমতার মাত্র ৭২.৭ শতাংশ ব্যবহার করছে। অর্থাৎ, শিল্পক্ষেত্রের উৎপাদন ক্ষমতার সিকি ভাগের কোনও ব্যবহারই হয়নি।
শিল্পক্ষেত্রে ব্যাংকঋণের পরিমাণ কতখানি বাড়ছে, সেটাও অর্থনৈতিক বৃদ্ধির একটা ভাল নির্দেশক। কারণ, ঋণের টাকা ব্যবহার হয় নতুন কারখানা তৈরির কাজে, অথবা পুরনো কারখানার সম্প্রসারণে। বড়, মাঝারি, ক্ষুদ্র— সব ধরনের শিল্পকে দেওয়া ব্যাংকঋণের বৃদ্ধির হার ২০১৫-১৬ সালে স্মরণাতীত কালের মধ্যে সবচেয়ে কম হয়ে ২.৭ শতাংশে পৌঁছেছে। সাম্প্রতিক কালে, ২০০৯-১০ সালেও, শিল্পকে দেওয়া ব্যাংকঋণের বৃদ্ধির হার ছিল ২৪.৪ শতাংশ।
নরেন্দ্র মোদীর ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র আসল ছবিটা, অতএব এ রকম— দেশি বা বিদেশি, কোনও পুঁজিরই বৃদ্ধি ঘটেনি; কর্মসংস্থান স্বাভাবিক ভাবেই আশানুরূপ নয়; লগ্নিকারীরা ব্যাংকঋণ নিচ্ছেন না মানে তাঁরা অদূর ভবিষ্যতেও যথেষ্ট আর্থিক বৃদ্ধি প্রত্যাশা করছেন না; উৎপাদনশীলতাও নিম্নমুখী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy