Advertisement
E-Paper

অপ্রস্তুত করাই কি স্কুলের কাজ

সে রাজ্যের এক স্কুলের একটি ক্লাস ইলেভেন-এর মেয়েকে তার কৃতিত্বের আনন্দে জড়িয়ে ধরেছিল তারই এক বন্ধু। সেই ছেলেটিও ওই স্কুলেই পড়ে, ক্লাস টুয়েলভ।

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:৪৩

এখন সবাই সব বোঝেন। ‘শ’ বললে শরীর অথচ শত্রু নয় কিন্তু, ‘স’ বললে সম্পর্ক অথচ সন্ধি নয়, আর ‘ব’ বললে বন্ধুত্ব নয়, ব্যভিচার! সমাজের বৈতরণি পারের দায়িত্ব যাঁদের, তাঁদের একটা আস্ত মানে বই আছে, অভিধানের চেয়েও বড়। সুতরাং আমরা নাদান, যা বুঝি ভুল বুঝি বা উলটো বুঝি। সে রকমই উলটো বুঝলাম কেরলের একটি ঘটনায়।

সে রাজ্যের এক স্কুলের একটি ক্লাস ইলেভেন-এর মেয়েকে তার কৃতিত্বের আনন্দে জড়িয়ে ধরেছিল তারই এক বন্ধু। সেই ছেলেটিও ওই স্কুলেই পড়ে, ক্লাস টুয়েলভ। সঙ্গে সঙ্গে বকুনি, তলব, তুলকালাম। এবং ছেলেটি অনির্দিষ্টকাল সাসপেন্ড। মেয়েটিকেও সম্ভবত সাসপেন্ড করা হয়েছিল, তবে তা নিয়ে কিছুটা ধোঁয়াশা আছে। ছেলেটির বাবা এই শাস্তি মেনে নিতে রাজি হননি। কোর্টকাছারি, মিডিয়া, অনেক কিছুর পরে শেষ পর্যন্ত স্কুল কর্তৃপক্ষ ছেলেটির সঙ্গে কথা বলতে রাজি হয়েছেন, হয়তো ফিরিয়ে নিতেও। কিন্তু পাঁচ মাসের টানাপড়েনে তার পড়াশোনা, কেরিয়ার বিপন্ন।

প্রথম কথা হল, যদি কোনও স্কুলের নিয়মে থাকে যে ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে পড়লেও, তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরতে বা স্পর্শ করতে পারবে না, তা হলে স্কুলের মধ্যে সেই নিয়ম ভাঙা অন্যায়। কিন্তু সেটা মেনে নিলেও বলতেই হবে, কেরলের স্কুলটি লঘু পাপে গুরু দণ্ড দিয়েছে। ওই ছাত্রছাত্রীদের শাসন করা যেত, ‘এমনটা আর করব না’ প্রতিশ্রুতিও দাবি করা যেত। কিন্তু সাসপেন্ড করে পড়াশোনা থেকে বঞ্চিত করা কি একটা স্কুলের উচিত? যেখানে তারাই বিদ্যাদানের দায়িত্ব নিয়েছে? পড়াশোনার ক্ষতিই তো নয়, একটি কিশোর পাঁচ মাস স্কুল থেকে সাসপেন্ড হয়ে থাকলে তার নিজের প্রতি বিশ্বাস কতটা টালমাটাল হতে পারে, সেটা স্কুল জানে না? একটি মেয়েকে ‘খারাপ মেয়ে’ বলে চিহ্নিত করে তার উদ্দেশ্যে নানা কুরুচিকর মন্তব্য করা হচ্ছে, এর ফলে তার মন কোথায় গিয়ে ঠেকতে পারে, স্কুল ভাববে না?

এ বার আসা যাক ন্যায়-অন্যায়ের কথায়। ছেলেটির বক্তব্য, সে নিতান্ত স্বাভাবিক ভাবেই বন্ধুকে জড়িয়ে ধরেছিল, তার মনে অন্য কোনও অনুভূতি ছিল না, উদ্দেশ্য ছিল না। মেয়েটির বক্তব্যও তা-ই। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ ওদের আচরণে ‘অন্য রকম ব্যাপার’ বুঝতে চেয়েছেন। মুশকিলটা এখানেই। ছাত্র-ছাত্রী বলছে তারা পাঁচ সেকেন্ড পরস্পরকে এমনিই আলিঙ্গন করেছে, আর স্কুল কর্তৃপক্ষ বলছেন পাঁচ মিনিট, এবং ‘বেশিক্ষণ’ জড়িয়ে ধরে থাকার মধ্যে অন্য রকম উদ্দেশ্য খুঁজছেন— এখানেই রয়েছে তাঁদের সুচেতনায় বড় রকমের ফাটল।

মুশকিল হল, সময় এগিয়ে গিয়েছে, যুগ বদলে গিয়েছে, বাইরের জগৎ পালটে গিয়েছে। কিন্তু অনেক স্কুল, অনেক শিক্ষক চিন্তাভাবনায় পুরনো যুগে পড়ে রয়েছেন। এর ফলে স্কুল ক্ষুব্ধ, আর ছেলেমেয়েরা বিহ্বল। স্কুলের বাইরে তারা দেখছে আধুনিক জগৎ, তার এগিয়ে যাওয়া, আর স্কুলে তারা পাচ্ছে অন্য শিক্ষা। ছেলে-বন্ধু মেয়ে-বন্ধু প্রকাশ্যে একে অপরকে জড়িয়ে ধরবে, এমনটা সে কালে স্বাভাবিক ছিল না, এ কালে অনেকের কাছেই স্বাভাবিক। যাঁরা ভাবছেন আসলে এই জড়িয়ে ধরার মধ্যেও আকর্ষণ ছিল, চেতনে না হলেও অবচেতনে ছিল, এটা তাঁদের ভাবনা। তাঁরা তাঁদের মতো করে ভাবতেই পারেন। এবং এই নিয়ে তর্কও চলতেই পারে। কিন্তু তার বোঝা অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে কেন?

স্কুল এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে শিশুরা শৈশব থেকে কৈশোর পেরিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠে। জীবন গড়ার ভিত তৈরি করে দেয় স্কুল। কেবল পুঁথিগত শিক্ষা নয়, বাইরের জগৎ সম্পর্কে বোধ তৈরি করে, তার সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য শিশু-কিশোরকে তৈরি করে স্কুল, যাতে সে জীবনের যোগ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু যখন সেই স্কুল, এক জন ছেলে বা মেয়েকে জীবনের জন্য অ-যোগ্য করে গড়ে তোলে? ভুল পথে চালিত করে? স্কুল যদি ছেলে এবং মেয়ের মধ্যে স্বাভাবিক বন্ধুতা বা সম্পর্ককে স্বাভাবিক চোখে না দেখে অন্য চোখে দেখে, তা হলে কেবল এই ছেলে-মেয়ে দুটি কেন, স্কুলের প্রতিটি ছেলে-মেয়ের মধ্যেই তো একটা ভুল ধারণা তৈরি হবে! বিশেষ করে, ছেলেরা ধরেই নেবে ‘মেয়েরা আলাদা’, তাদের কেবল বন্ধু বলে দেখলে হবে না, কারণ তারা যৌনতা দিয়ে তৈরি, উত্তেজক, ফলে তাদের জড়িয়ে ধরার মধ্যে অশালীনতা আছে।

এই ভাবেই স্কুলের মতো একটি প্রতিষ্ঠান তার গণ্ডির ভিতরে ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে একটা অসাম্যের ধারণাকে লালন করছে, এবং প্রশ্ন তুললে, সেই ধারণায় অবিচল থাকছে শৃঙ্খলার দোহাই দিয়ে। এই ভুল পথ ধরেই কিন্তু ছেলেমেয়েদের মধ্যে পিতৃতান্ত্রিক সংস্কারগুলো ঢুকতে থাকবে, জোরদার হবে। এই ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে পিতৃতন্ত্রের সঙ্গে লড়াই করবে? তারা তো জানবে এই তন্ত্রই ঠিক। এমন করেই মেয়েদের প্রতি আচরণ করতে হয়, এমন করেই ছেলেদের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলতে হয়।

তার মানে এই নয় যে শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের বলবেন, উচ্ছন্নে যাও। তার মানে এই যে, শিক্ষক সবটা জেনেবুঝেশিখে নিয়ে, তার থেকে নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে ঠিক নির্যাসটুকু নিংড়ে, সেই ছাঁকনিতে তোলা শিক্ষাটা দিয়ে তালিম দেবেন ছাত্রছাত্রীদের। তবেই তাঁরা উপযুক্ত কাজটি করতে পারবেন।

স্কুল ক্ষমতার প্রতীক। হাতে ক্ষমতা থাকলে সাসপেন্ড তো করেই দেওয়া যায়। কিন্তু ক্ষমতার সঙ্গে আরও একটি জিনিস হাতে আসে, তা হল দায়িত্ব। নিজেকে শিক্ষিত করার দায়িত্ব, নিজেকে যোগ্য করে তোলার দায়িত্ব।

বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: সব শিক্ষক ক্ষমতার অপব্যবহার করেন না। সব স্কুল মান্ধাতার আমলে পড়ে নেই।

Schools Discrimination Students
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy