মা র্ক জুকেরবার্গ ক্ষমা চাহিয়াছেন। মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরির কাজে তাঁহার ফেসবুক যে ভাবে ব্যবহৃত হইতেছে, তাহার জন্যই এই ক্ষমাপ্রার্থনা। জুকেরবার্গ জানাইয়াছেন, তিনি এই ভুল সংশোধনের চেষ্টা করিবেন। কেহ প্রশ্ন করিতেই পারেন, মার্কিন কংগ্রেসের তদন্ত এবং বিশেষ তদন্তকারী দলের প্রশ্নের মুখে পড়িয়াই কি বিবেকের ঘুম ভাঙিল? নচেৎ, ফেসবুকে ভাসিয়া বেড়ানো ‘ফেক নিউজ’-এ কতখানি ক্ষতি হইতেছে, বারংবার সেই কথা স্মরণ করাইয়া দেওয়ার পরেও জুকেরবার্গ এত দিন তোয়াক্কা করেন নাই। বলিয়াছেন, ফেসবুক একটি প্ল্যাটফর্ম মাত্র, কোনও সংবাদ সংস্থা নহে। অতএব, দায় তাঁহাদের নহে। অকস্মাৎ জুকেরবার্গের অপরাধবোধ জাগিয়া উঠায়, অতএব, সন্দেহ হইতেই পারে। তবুও ধরিয়া লওয়া যাক, তাঁহার সদিচ্ছাটি খাঁটি। তবুও প্রশ্ন উঠিবে, ক্রমবর্ধমান সরকারি নজরদারিও কি একই ভাবে এড়াইয়া চলা সম্ভব হইবে? সম্প্রতি ভারতেই অভিযোগ উঠিয়াছে, কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনা করা হইয়াছে, এমন নিবন্ধ ফেসবুকে চলিতে পায় না— তাহাকে লুকাইয়া ফেলা হয়। এই অভিযোগটি কত আনা খাঁটি, তাহা ভিন্ন প্রশ্ন, কিন্তু সরকারের মন রাখিয়া চলিবার অভিযোগ ফেসবুকের বিরুদ্ধে বারংবার উঠে। পাশাপাশি, বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা ফেসবুকের তথ্য বিশ্লেষণ করিয়া দাবি করিয়াছে, ফেসবুকের অ্যালগরিদ্ম এমনই যে ব্যবহারকারীর নিকট তাঁহার বিরুদ্ধ মতের কোনও তথ্য পৌঁছায় না। ফেসবুকে প্রত্যেকেই নিজের মতের প্রতিধ্বনি শুনিতে পান মাত্র। আধুনিক দুনিয়ায় ফেসবুকই যখন ক্রমে বৃহত্তম সংবাদমাধ্যম হইয়া উঠিতেছে, তখন এই অভিযোগগুলিকে যথাবিধি গুরুত্ব দিতে হইবে বইকি।
গোটা দুনিয়াতেই সংবাদের মাধ্যম হিসাবে ফেসবুকের গুরুত্ব ক্রমবর্ধমান। তাহার ব্যাপ্তি যতখানি, দায়বদ্ধতা তাহার তুলনায় কম। কারণ— জুকেরবার্গ যাহা বলিয়া থাকেন— ফেসবুক প্ল্যাটফর্মমাত্র, সেখানে সংবাদ লেখা হয় না, শুধু ‘শেয়ার’ করা হয়। ফলে, সৎ সংবাদের পাশাপাশি বহুবিধ মিথ্যা সংবাদও সেই প্ল্যাটফর্মে সমান তালে চলিতে পারে। অনেকে স্বেচ্ছায় সেই মিথ্যায় বিশ্বাস করেন, অনেকে না বুঝিয়া। ফেসবুক হইতে যাঁহারা সংবাদ আহরণ করেন, তাঁহাদের অনেকেরই অন্য কোনও প্রথাগত সংবাদমাধ্যমের সহিত যোগাযোগ নাই। ফলে, সত্য-মিথ্যার ফারাক করা তাঁহাদের নিকট দুষ্কর। এবং, এই ফাঁক গলিয়াই মিথ্যা সংবাদ মান্যতা পাইতেছে। তাহার ভিত্তিতে বিদ্বেষ ছড়াইতেছে, দাঙ্গাও হইতেছে। ফেক নিউজ বা মিথ্যা সংবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধটি এখন আন্তর্জাতিক। এবং, যত দিন না ফেসবুক এই যুদ্ধে ধর্মের পক্ষে দাঁড়াইতেছে, জয়ের আশা ক্ষীণ।
সেই কারণেই জুকেরবার্গের ক্ষমাপ্রার্থনাটি গুরুত্বপূর্ণ। মিথ্যা সংবাদ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সংস্থাটির উপর যে চাপ তৈরি হইয়াছে, তাহার পাশাপাশি আরও একটি তাগিদ থাকা স্বাভাবিক— এই কথাটি যদি জনমানসে প্রামাণ্যতা অর্জন করে যে ফেসবুকের কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা নাই, তবে তাহার উপর মানুষের নির্ভরশীলতাও কমিবে। এবং, তাহাতে বিজ্ঞাপনের জোয়ারও বন্ধ হইয়া যাইবে। জুকেরবার্গ বিলক্ষণ জানেন, বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির দুনিয়ায় কোনও একটি সংস্থা কার্যত চোখের নিমেষে মুছিয়া যাইতে পারে। যে বিপুল সাম্রাজ্য তিনি তৈরি করিয়াছেন, এত সহজে তাহাকে হাতছাড়া করিবার মতো ভুল জুকেরবার্গ করিবেন না, ইহাই আশার কথা। তবে, মিথ্যা সংবাদ কী ভাবে চিনিতে হয়, শুধু সেই বিজ্ঞাপন ছাপিয়াই দায় সারিলে চলিবে না। সত্যই চেষ্টা করিতে হইবে। গুগ্ল ইতিমধ্যেই কাজ আরম্ভ করিয়াছে। এই বার ফেসবুকের পালা। শুধু ক্ষমাপ্রার্থনায় চিঁড়া ভিজিবে না।