Advertisement
E-Paper

আবেগ ফেসবুকে মানায়, ওঁরা স্রেফ চাকরি চান

শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা, এ ভাবেই ছুটতে থাকেন ওঁরা। প্রতি দিন। নিয়ম করে। কেন? হাঁপাতে-হাঁপাতে উত্তর আসে, ‘সামনে লাইন আছে।’

গৌরব বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০১৮ ০৬:০০
দৌড়: দারিদ্রকে হারানোর দৌড়, মাসান্তে নিশ্চিত রোজগারের লক্ষ্য ছোঁওয়ার দৌড়। ‘শহিদ’ হওয়ার দৌড় নয়

দৌড়: দারিদ্রকে হারানোর দৌড়, মাসান্তে নিশ্চিত রোজগারের লক্ষ্য ছোঁওয়ার দৌড়। ‘শহিদ’ হওয়ার দৌড় নয়

পৌষের হাড়হিম করা ঠান্ডা, সঙ্গে জমাট কুয়াশা। সেই সাদা আস্তরণ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে কয়েকটা মূর্তি। পরনে হাফপ্যান্ট, টি-শার্ট আর সস্তার কেডস। কেউ ইতিমধ্যে পাঁচ কিলোমিটার দৌড় সেরে ফেলেছে পাড়ার ফুটবল মাঠে। কারও গন্তব্য ভেজা পিচরাস্তা ধরে আরও দশ কিলোমিটার। ছুটতে ছুটতে শীতভোরেও ঘামে ভিজে গিয়েছে টি-শার্ট। কিন্তু দম ফুরোলে চলবে না। ‘রান’ শেষ না করে থামবেন না কেউ।

শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা, এ ভাবেই ছুটতে থাকেন ওঁরা। প্রতি দিন। নিয়ম করে। কেন? হাঁপাতে-হাঁপাতে উত্তর আসে, ‘সামনে লাইন আছে।’

‘লাইন’ অর্থাৎ বিএসএফ, সিআরপিএফ বা সেনায় ভর্তির পরীক্ষা। চাকরির পরীক্ষা। জীবনের পরীক্ষা। এক বার পাশ দিতে পারলেই নিশ্চিত ভবিষ্যৎ। মাসের শেষে নিশ্চিত রোজগার। সেই টাকায় ঘুচবে সংসারের আঁধার। মুছবে বেকারত্বের অপমান। অসুস্থ বাবার চিকিৎসা হবে। বোনের বিয়ে হবে। চাই কী, গুছিয়ে নিজেরও একটা সংসার!

মুর্শিদাবাদের বিএ দ্বিতীয় বর্ষের অনুপ দাস বা উচ্চ মাধ্যমিক দিয়ে লেখাপড়ায় ইতি টেনে দেওয়া রিয়াজুল শেখরা বলছেন, ‘বিএসএফ, সিআরপিএফ, মিলিটারি— যেটা লাগবে, সেটাতেই ঢুকে পড়ব। মোদ্দা কথা, চাকরিটা চাই!’ কিন্তু এ চাকরিতে তো ঝুঁকি আছে। আছে মৃত্যুর সম্ভাবনাও। তা হলে? ছুটতে ছুটতেই হাসেন ওঁরা। ‘জানি তো। কিন্তু সেই ভয়ে থেমে গেলেও তো চলবে না। বাড়িতেই বা কোন সুখে আছি, বলুন?’

আরও পড়ুন: ‘এই গোলমালের সুযোগ রাজনীতিকরা নিলে বিপদ’

অনুপ-রিয়াজুলেরা যে জেলার বাসিন্দা, সেই মুর্শিদাবাদেরই লোক তো রাধাপদ হাজরাও। তিনিও তো চেয়েছিলেন একটা চাকরিই। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে, দিনরাত এক করে ১৯৯১ সালে শিকেও ছিঁড়েছিল। বাড়ির কারও আপত্তি ধোপে টেকেনি। সটান নাম লেখান বিএসএফে। দীর্ঘ চাকরি জীবনে জম্মু ও কাশ্মীরে তিন বার পোস্টিং— এক বার পায়ে গুলি খাওয়া ছাড়া মোটামুটি মসৃণ।

হোঁচট খেতে হল ৩ জানুয়ারি, রাধাপদর জন্মদিনে। দুপুরে স্ত্রী সুজাতার ফোন পৌঁছয় পাক সীমান্তে চাক দুলমা পোস্টে। তড়িঘড়ি কয়েকটা কথা, ‘খুব কাজের চাপ। যে কোনও সময়ে ফোন কেটে যেতে পারে। তোমরা ভাল থেকো।’ সেই সন্ধ্যাতেই বিএসএফ থেকে ফোন এল— সাম্বা সেক্টরে পাক স্নাইপারের গুলিতে নিহত হয়েছেন বিএসএফের ১৭৩ নম্বর ব্যাটেলিয়নের হেড কনস্টেবল রাধাপদ হাজরা। ‘শহিদ’ রাধাপদকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া কেঁদে-ককিয়ে অস্থির। মিডিয়া পেয়ে গেল ব্রেকিং নিউজ। পাথর শুধু রাধাপদর মা, স্ত্রী, সদ্য কৈশোর পেরনো দুই ছেলেমেয়ে। ঘরের সিলিংয়ে ঠোক্কর খায় ডুকরে ওঠা বিলাপ— ‘কাশ্মীর যেতে কত বার নিষেধ করেছিলাম। সে কথা শুনলে কিছুতেই এমনটা হত না গো!’

সত্যিই রাধাপদ কারও কথা শোনেননি। সেখানকার অবস্থা যে ভাল নয়, তা ভূভারত জানে। কিন্তু ‘শহিদ’ হওয়ার আগের রাধাপদ তো এক জন বাবা, স্বামী, ছেলে। সংসারের জটিল পাটিগণিতের আঁক কষতে হত তাঁকেও। একমাত্র ছেলে, রাহুল এ বার উচ্চ মাধ্যমিক দেবে। মেয়ে রাজেশ্বরী নার্সিং পড়ছে। তাদের পড়াশোনার জন্যই গাঁ ছেড়ে বাসা ভাড়া করেছিলেন নদিয়ার করিমপুরে। মাস আটেক আগে সেই ভাড়াবাড়ি ছেড়ে নাজিরপুরে নিজের বাড়িতে গিয়ে উঠেছেন। বাড়ির কেউ অবসর নেওয়ার পরামর্শ দিলেই বলেছেন, ‘বাড়ি করতে গিয়ে টাকা তো সব প্রায় শেষ। ছেলেমেয়ের পড়াশোনারও তো খরচ আছে। আর কয়েক বছর চাকরিটা করেই নিই।’

আজ্ঞে হ্যাঁ, চাকরি। ঝুঁকি আছে জেনেও। সম্ভাব্য কিংবা নিশ্চিত মৃত্যু আছে জেনেও। ‘শহিদ’, ‘দেশপ্রেমী’— শব্দগুলো তো আসলে আরোপিত। কখনও রাষ্ট্র, কখনও মিডিয়া, কখনও হুজুগে নেটিজেনরা সময়-সুযোগ বুঝে এ শব্দগুলো ব্যবহার করেন। কিন্তু ওঁরা? যাঁরা সকাল-সন্ধ্যা হাফপ্যান্ট আর ঘামে ভেজা টি-শার্ট পরে ছুটছেন, যাঁদের লেখাপড়ার দৌড় ‘টেন প্লাস টু’, যাঁরা জানেন মাস্টার, ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হওয়া তাঁদের কম্ম নয়, তাঁরা? যাঁদের রোজ বিকেলে পাড়ার ক্লাবে গিয়ে শুনতে হয়, ‘কী হে, আর কদ্দিন? লাইনে যাওয়ার বয়স তো ফুরিয়ে এল!’ সকালে মাঠের দৌড়, দুপুরে খেতের কাজ সেরে এসেও যাঁদের বাড়া ভাতের সামনে বসে হজম করতে হয় মায়ের কথা, ‘কিছু একটা কর এ বার, বাবা তো একা আর পেরে উঠছে না!’ সদ্য ‘মেলেটারি’তে যোগ দেওয়া পাড়াতুতো দাদা যাঁকে আশ্বাস দেন, ‘তোর তো ভাল হাইট। শুধু মাঠটা পার কর। বাকিটা হয়ে যাবে’— তিনি? তাঁরা? সব্বাই ‘শহিদ’ হতে ছুটছেন?

মাঝে-মধ্যেই তো এ গাঁয়ে-ও গাঁয়ে তেরঙ্গায় মোড়া কফিনবন্দি দেহ আসে। তাতে কি চাকরির পরীক্ষার দৌড় থামে? যে দিন ভাগীরথীর পাড়ে শক্তিপুর ঘাটে রাধাপদর দেহ পুড়ে ছাই হল, সে দিন কি দৌড় থেমেছিল? কী করে থামবে? এক দিকে রোজ গায়ে ছ্যাঁকা দেওয়া দারিদ্র, অন্য দিকে মৃত্যুর দূরাগত সম্ভাবনা। যুদ্ধ তো বাধেনি! সীমান্ত পাহারা দেওয়া মানে তো আর যুদ্ধে যাওয়া নয়, আর যা-ই হোক। ও সব নিয়ে তাই ভাবার ফুরসতই নেই কারও। বরং যে বয়সে চাকরির জন্য দৌড়টা শুরু হয়, সে বয়সে মৃত্যু শব্দটা কুয়াশার মতো। ফলে প্রতি বছর যত কফিনবন্দি দেহ গ্রামে ফেরে, তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি ছেলেমেয়ে নাম লেখান সেনা কিংবা আধাসেনায়।

তা ছাড়া, পুবের ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত দেখে পশ্চিমে রাজস্থান, পঞ্জাব বা কাশ্মীর সীমান্তের অবস্থা ঠাহর করাও কার্যত কঠিন। পুবের সীমান্ত ঘেঁষা নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, মালদহ, কোচবিহার, দুই ২৪ পরগনার মানুষ জন্ম ইস্তক দু’দেশের সীমান্তরক্ষীদের দেখে আসছেন খুব কাছ থেকে। বছরে ক’টা দিন কাঁটাতারের দু’পাশ থেকে রাইফেলের নল এ-ওর দিকে তাক করে, বলা শক্ত। বরং বছরভর নিরাপদেই ‘ডিউটি’ করেন দু’দেশের সেপাই। কখনও-সখনও গালগল্প হয়, মাঝে-মধ্যে প্রীতি ফুটবল বা ভলিবলের আয়োজনও করেন উপরওয়ালারা। উৎসবে-পরবে মিষ্টি বিনিময়। বরং ছাপোষা গেরস্ত দূর থেকে অপার সমীহ নিয়ে দেখেন দুই পারের উর্দিধারীদের। তাঁদের চলন-বলন, দাপট। দেখেন আর মুগ্ধ হন! হয়ে উঠতে চান ও রকম!

মাঠের পাক-দৌড় শেষে প্রশিক্ষণ শুরু হওয়ার পরে হয়তো আস্তে আস্তে দূরাগত ঝুঁকিটা সামনে আসতে থাকে। কিন্তু তত দিনে স্বাচ্ছন্দ্যে অভ্যস্ত হতে শুরু করেছে হাড়-হাভাতে সংসার। আর তাঁরা বনে গিয়েছেন ‘দেশপ্রেমের দিনমজুর’। আর পিছু ফেরার উপায় থাকে না। বরং মাটি ছুঁয়ে থাকা সেপাইয়ের বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, তাঁর ভাগ্যে তেমন খারাপ কিছু ঘটবে না। কাশ্মীরে পোস্টিং সত্ত্বেও যেমনটা ভাবতে চেয়েছিলেন রাধাপদ। বা, ভাবতে চান সীমান্তের দু’পারে থাকা সব প্রান্তিক সেপাই। এ দেশের অনুপ-রিয়াজুলদের মতোই বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে ইরফান-কামালেরা। তাঁরাও তো চাকরি করতেই আসছেন!

খামখেয়ালি মৃত্যু সে চাকরির একটা শর্ত বই তো নয়!

social media Martyr Army emotion
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy