Advertisement
E-Paper

বাঁচা মানে ভয়ে ভয়ে থাকা

সমীক্ষার কাজ, লোকেদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। দিনে দিনে সে লোক পাব কোথায়, সন্ধে থেকে রাত গড়িয়েছে প্রায়ই, কোনও বিপদে পড়তে হয়নি, আতিথেয়তার ‘অত্যাচার’টা ছাড়া।

শুভ্রা দাস

শেষ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০১৭ ০০:০০

কিসের সার্ভে গো? তোমাদের কে পাঠিয়েছে? মোদী? সত্যি বলছি, আমাদের ঘরে ও সব কিছু নেই।’ না, উত্তর ভারতের কোনও জনপদ নয়, খাস কলকাতা শহরের একটা পাড়া, যার পরিপার্শ্বের নাম কবিতীর্থ, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রঙ্গলাল বন্দ্যপাধ্যায়, হেমচন্দ্র বন্দ্যপাধ্যায়ের স্মৃতিবিজড়িত। অদূরে সুফি সন্ত সৈয়দ বাবা, ওয়ারসি বাবার দরগা। নিকটে হেস্টিংস, বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংসের নিবাস, যেখানে মহারাজ নন্দকুমারের ফাঁসি। আশেপাশে পতিতপাবন দুর্গা মন্দির, ভূকৈলাস রাজবাড়ি, বার্নাবাস চার্চ, খ্রিস্টান মিশনারিদের পরিচালনাধীন বহু স্কুল। জায়গটার নাম শুনলে মহানগরীর অনেকের ‘বুক কেঁপে ওঠে’, কেননা, ‘সেটা মুসলমানদের পাড়া’! আমাদেরও শুনতে হয়েছিল, ‘খিদিরপুরে সার্ভে করতে যাচ্ছ? দিনে দিনে ফিরে এসো বাপু’।

সমীক্ষার কাজ, লোকেদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। দিনে দিনে সে লোক পাব কোথায়, সন্ধে থেকে রাত গড়িয়েছে প্রায়ই, কোনও বিপদে পড়তে হয়নি, আতিথেয়তার ‘অত্যাচার’টা ছাড়া। আমাদের যা কাজ তাতে বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে কথা বলাটাই ছিল প্রধান, তা তাঁদের অনেকে সারা দিন কাজের জন্য বাড়িছাড়া, আবার অনেকে বাড়ির ভেতর বন্দি, পুরুষরা কাজে যাওয়ার সময় বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে যান, যাতে বাইরের কোনও লোক এসে বাড়ির মেয়েদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে না পারে। এটুকু শোনামাত্র, কেউ কেউ হইহই করে উঠবেন, মুসলমান তো! মেয়েদের গৃহবন্দি করে রাখাই তো ওদের চল। না, ব্যাপারটা অত সরল নয়। গৃহবন্দিত্বের ব্যাপারটা সাম্প্রতিক; এ বার গ্রীষ্ম-বর্ষা জুড়ে সারা দেশে গোরক্ষার নামে যে তাণ্ডব, সেই ভয়টা আমাদের মহানগরীতেও কড়া নেড়ে গিয়েছে। তালা লাগানোটা এই তাণ্ডবের আশঙ্কায়।

ভয় এতটাই যে, লোকে প্রথমে কথাই বলতে চাননি। তাঁদের ভয়, আমরা গোমাংস বিষয়ে খোঁজখবর করতে গিয়েছি। কিন্তু ক্রমে ভয় কেটেছে। গবেষণার কাজে লোকেদের সঙ্গে যত মিশছি, ততই দেখছি, তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই যেমন চমৎকার মানুষ, তেমনি তাঁদের প্রত্যেকের মধ্যে আছে এক ধরনের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান— কে কী উদ্দেশ্যে এসেছে তা বুঝে নেওয়ার।

সেই বোধ থেকে কথা বলছিলেন ফতিমা। অনেক দিন খিদিরপুরে। এই এক কামরার ঘরে বছর পাঁচেক। ইচ্ছা ছিল খিদিরপুর মোমিনপুর এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় ঘর ভাড়া নেওয়ার, কিন্তু কেউ ভাড়া দিতে চাইল না। ভাড়া না দেওয়ার হাজার কারণ বললেও সত্যি কারণটা ওঁরা জানতেন, সেটা হল ওঁরা মুসলমান। এখানেই থাকেন ঠিকানাহীন ঘরে। বাড়িটার খাতায় কলমে ঠিকানা নেই, শুনেছেন অবৈধ ভাবে তৈরি। এখন এই ঘরে আব্বা, আম্মা আর তিন ভাইবোনের সঙ্গে বসবাস। কাছাকাছি অনেক বাড়ি থাকায় ঘরে দিনের বেলাতেও আলো আসে না। অসুবিধা হয়, তবে অসুবিধাকেই অভ্যাস করে নিয়েছেন। বর্ষাকালে সমস্যা হয় দ্বিগুণ, ঘরের ভিতরে পানি পড়ে, এলাকাতে অল্প বৃষ্টিতেই হাঁটু পর্যন্ত জল জমে যায়, আর জল জমা মানে নরক।

গোস্ত নিয়ে কথা উঠলেই বলেন ফতিমা, ‘‘যা সব হচ্ছে, এ নিয়ে একটা কথা বলাও ভয়ের ব্যাপার। গরুর জন্য লোককে মেরে ফেলা হচ্ছে, তার পরও ভয় পাব না? শুধু গোস্ত খাওয়া নিয়েই তো সমস্যা নয়, আরও বড় সমস্যা রোজগারের। আমার ফুফাতো ভাই চামড়ার কাজ করত, সে আজ কাজ হারিয়ে বেকার ঘরে বসে আছে।’’

আর হিন্দু-মুসলমান বিরোধ? ‘‘কক্ষনো না। এ পাড়ার নাম মুসলমান পাড়া, কিন্তু কত হিন্দুও তো থাকে এখানে, খাটে খায়, অনেকেই একসঙ্গে ঘোরাঘুরি করে। হ্যাঁ, কেউ কেউ তফাত থাকে, যাদের দিন আনি দিন খাই অবস্থা নয়, তারা ভদ্রলোক। গরিব লোকের ধর্ম নিয়ে ভাবার সময় কোথায়, উৎসব আনন্দে একটু মাতামাতি, ব্যস! সকালে খাটতে বেরিয়ে যায়, সন্ধ্যায় ফেরে। বড়লোক হিন্দুরা মেশে না আমাদের সঙ্গে, সে তো বড়লোক মুসলমানরাও মেশে না।’’

রাজনীতির কথা তুললে ফতিমার সাফ জবাব, ও সব নেতাদের ব্যাপার। জোর যার মুলুক তার। যে পারছে কামাচ্ছে, পয়সা করছে, বেল পাকলে কাকের কী, আমরা চিরদিন খেটে মরব, তবু ভাতের জোগাড় হবে না। নেতারা যদি আমাদের কথা ভাবত, আমাদের এই অবস্থা হত? আর এই গৃহবন্দি দশা? ‘‘এ তো ইদানীংকার ব্যাপার। কে আর বাড়ির মধ্যে তালাবন্ধ থাকতে চায়? কিন্তু উপায় কী? সত্যিই তো, যদি কেউ খবর নিতে আসে, ঘরে গোস্ত আছে কি না, গোস্ত খাই কি না, তখন কী বলতে কী বলে বসব, তার পর থানাপুলিশ, সে সব কে সামলাবে? হয়তো আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।’’

যে সময়কার কথা বলছি, তার পর প্রায় তিন মাস অতিক্রান্ত। সময়ের কাছে হয়তো ভয় হার মেনেছে। কিন্তু যে সময়টা জুড়ে ভয় ছিল, তা তো মিথ্যা নয়। আর সেই কারণেই, তার ফিরে আসাটাও অসম্ভব না হতে পারে। যে রাজ্যে ক্ষমতাসীন সরকারকে অহরহ দোষী করা হচ্ছে মুসলমান তোষণের কারণে, সে রাজ্যেই যদি ফতিমাদের এমন ভয়ে বাঁচতে হয়, গো-পূজকদের দাপটে শাসিত রাজ্যগুলির অবস্থা কল্পনা করতেই আতঙ্ক হয়।

প্রতীচী ইনস্টিটিউট-এ গবেষক

Minority society Cow vigilante
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy