সঙ্ঘ পরিবারের বৃহৎ হিন্দুত্ব যে একখানি সোনার পাথরবাটি, তাহা লইয়া সংশয়ের কোনও কারণ নাই, কখনও ছিলও না। ভারতীয় সমাজ এবং রাজনীতির ইতিহাস সম্বন্ধে মৌলিক ধারণাটুকু থাকিলেই বুঝিতে অসুবিধা হয় না যে, বহু যুগের অত্যাচারলাঞ্ছিত ব্যবধানকে মুছিয়া ব্রাহ্মণ্যবাদ আর দলিত অস্তিত্বকে অদ্বৈতে প্রতিষ্ঠা করা যায় না। কিন্তু ভারতীয় জনতা পার্টির নেতাদের ইতিহাস-বোধের সুখ্যাতি নাই। তদুপরি ক্ষমতার আকর্ষণ অতি প্রবল। সুতরাং নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি আপন হিন্দুত্বের শিবিরে দলিতদের সমবেত করিতে বিশেষ তৎপর। বাবাসাহেব অম্বেডকরকে অবধি সেই রাজনীতির হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করিতে তাঁহারা তৎপর। কিন্তু ফাঁকি দিয়া বেশি দিন চলে না। দলিত সমস্যা উত্তরোত্তর মোদীশাহির প্রধান সঙ্কট হইয়া দাঁড়াইতেছে। গত কয় দিনে দলিতদের ক্ষোভের বিস্ফোরণকে শুধুমাত্র সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ের প্রতিক্রিয়া হিসাবে দেখিলে মস্ত ভুল হইবে। আন্দোলনকারীদের স্লোগানই বলিয়া দিয়াছে, দলিত-প্রশ্নে বিজেপি যে স্ববিরোধী নীতি গ্রহণ করিয়াছে, এই ক্ষোভে তাহারই প্রত্যাখ্যান ধ্বনিত। এক দিকে বৃহৎ হিন্দুত্বের রেটরিক, অন্য দিকে দলিতদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান হিংস্রতা ও সেই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর চর্চিত নীরবতা— একই সঙ্গে যে এই দুইটি চলিতে পারে না, দলিতরা স্পষ্ট জানাইয়া দিলেন। তাঁহাদের আন্দোলনের হিংস্রতা নিন্দনীয়, কিন্তু ক্ষোভটি খাঁটি।
দলিত রাজনীতিকে হিন্দুত্ববাদের তিমিঙ্গিল গিলিয়া লইতে পারে, এই ভাবনায় ভুল ছিল। আরও বড় ভুল, দলিত রাজনীতি বলিতে ঠিক কী বুঝায়, তাহা ধরিতে না পারা। অতিসরলীকরণের ঝুঁকি লইয়া বলা চলে, দলিত রাজনীতিতে একটি বিংশ বনাম একবিংশ শতকের বিভাজিকা তৈরি হইয়াছে। মায়াবতীরা প্রথম ঘরানায় বিশ্বাসী, যেখানে মূলত রাজনৈতিক পরিসরটিতে দলিতদের উপস্থিতি প্রতিষ্ঠা করাই লক্ষ্য ছিল। জিগ্নেশ মেবাণীরা একুশ শতকের রাজনীতি করেন। তাঁহাদের রাজনীতি অধিকারের, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিসর দখলের। অস্বীকার করিবার কোনও কারণ নাই, কাঁসিরাম ছিলেন বলিয়াই মেবাণী আছেন— রাজনৈতিক পরিসরটিতে অধিকার প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে বলিয়াই অন্যতর অধিকারের দাবি তোলা সম্ভব হইতেছে। কিন্তু, দলিতদের এই উচ্চাশার রাজনীতিটিকে বিজেপি বুঝিতেই পারে নাই। তাহার কারণ, বৃহৎ হিন্দুত্ব মুখে যতই থাকুক, বিজেপির অন্তরে মনুবাদের অটল আসন। নিম্ন বর্গের উচ্চাশাকে অন্তর হইতে মানিয়া লওয়া নাগপুরের পক্ষে অসম্ভব। সেই কারণেই সংঘাত, সেই কারণেই দলিতদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান হিংস্রতা।
সংঘাত বাস্তব। হিংস্রতাও। সুপ্রিম কোর্টের রায়টিকে সেই পরিপ্রেক্ষিতে পাঠ করা বিধেয়। রায় স্থগিত রাখিতে অসম্মতি জানাইয়া আদালত বলিয়াছে, রায়টিতে দলিতদের উদ্বেগের কারণ নাই। ইহা শুধুমাত্র ১৯৮৯ সালের আইনটির অপব্যবহার বন্ধ করিবার ব্যবস্থা। আদালতের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রাখিয়াও দুইটি প্রশ্ন করা প্রয়োজন। এক, আইনটির অপব্যবহারের হার কী? তাহার সহিত দলিতদের বিরুদ্ধে হিংস্রতার ঘটনার সংখ্যার তুলনা করিলে অনুপাতটি কত দাঁড়াইবে? স্পষ্ট উত্তর মিলে নাই। দ্বিতীয় প্রশ্ন, যখন দলিতদের উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতিক্রিয়ায় উচ্চ বর্ণের হিংস্রতার ঘটনা বাড়িতেছে, ঠিক সেই সময়েই যদি অপব্যবহার বন্ধ করিবার নামে আইনটিকে ব্যবহার করা কঠিনতর হইয়া উঠে, তখন কি সেই ফাঁক গলিয়া হিংস্রতা আরও বাড়িবে না? আইন বা বিচারপ্রক্রিয়া শূন্যে নিরালম্ব নহে, তাহার বাস্তব পরিপ্রেক্ষিত থাকে। ভারতে, বিশেষত মোদীর ভারতে সেই পরিপ্রেক্ষিতটি দলিতদের অনুকূল নহে, তাহা বোধ করি তর্কাতীত। মহামান্য আদালত এই সত্যটিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়াছেন কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy