Advertisement
E-Paper

যত দিন তত দিন

শ্রীমোদী ক্ষমতার জোরে পরিসংখ্যান চাপিয়া রাখিতে পারেন, কিন্তু ভারতবাসী প্রত্যহ তাঁহার ‘অচ্ছে দিন’-এর আঁচে ঝলসাইতেছে। শিল্প উৎপাদনের সূচক, কর্মসংস্থানের হার, বাজারে চাহিদার অধোগতি, সবই এক গল্পের বিভিন্ন অধ্যায়। ভোগব্যয়ের হার কমিয়া যাওয়া সেই গল্পই বলিতেছে, কিন্তু এই বিপদ কেন, সেই কারণটির দিক্‌নির্দেশও এই সূচকে রহিয়াছে।

শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০১৯ ০০:২১
নরেন্দ্র মোদী।—ফাইল চিত্র

নরেন্দ্র মোদী।—ফাইল চিত্র

নাগপুরের কর্তারা মর্মাহত হইবেন, কিন্তু যে বিশ্বনায়কের সহিত নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীর সাযুজ্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইতেছে, তাঁহার নাম জোসেফ স্ট্যালিন। অনেক ক্ষেত্রেই মিল, তবে পরিসংখ্যান নামক নৈর্ব্যক্তিক বস্তুটিকে কী ভাবে রাজনীতির ঘোলাজলে শ্বাস রোধ করিয়া মারিতে হয়, সেই বিষয়ে উভয় নেতার মিল বিস্ময়কর। স্ট্যালিনের আমলে সোভিয়েত ইউনিয়নে কোনও অস্বস্তিকর পরিসংখ্যান দিনের আলো দেখিতে পাইত না। সেই শূন্যস্থান পূরণ করিত কল্পিত— শাসকদের পক্ষে অনুকূল— সংখ্যারাশি। কেন্দ্রীয় সরকার সম্প্রতি যে ভঙ্গিতে এনএসএসও-র ভোগব্যয় সংক্রান্ত সমীক্ষার রিপোর্ট বাজে কাগজের ঝুড়িতে নিক্ষেপ করিল, তাহাতে স্ট্যালিনের পদধ্বনি সুস্পষ্ট। সমীক্ষায় নাকি দেখা গিয়াছিল, ২০১১-১২’র তুলনায় ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষে ভোগব্যয় ৩.৭ শতাংশ কমিয়াছে। বেশ কয়েক দশকে খাদ্যপণ্য বাবদ ভোগব্যয় এত কম হয় নাই। সংবাদটি প্রকাশিত হওয়ার দিনই কেন্দ্রীয় সরকার জানাইয়া দিল, সমীক্ষায় গলদ রহিয়াছে, ফলে নূতন সমীক্ষা না হওয়া অবধি পরিসংখ্যান প্রকাশিত হইবে না। কর্মসংস্থান কমিতেছে, এমন কথা বলায় ঠিক এই ভঙ্গিতেই সেই পরিসংখ্যানকেও গায়েব করিয়া দিয়াছিল সরকার।

শ্রীমোদী ক্ষমতার জোরে পরিসংখ্যান চাপিয়া রাখিতে পারেন, কিন্তু ভারতবাসী প্রত্যহ তাঁহার ‘অচ্ছে দিন’-এর আঁচে ঝলসাইতেছে। শিল্প উৎপাদনের সূচক, কর্মসংস্থানের হার, বাজারে চাহিদার অধোগতি, সবই এক গল্পের বিভিন্ন অধ্যায়। ভোগব্যয়ের হার কমিয়া যাওয়া সেই গল্পই বলিতেছে, কিন্তু এই বিপদ কেন, সেই কারণটির দিক্‌নির্দেশও এই সূচকে রহিয়াছে। বাতিল হইয়া যাওয়া পরিসংখ্যানটি ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষের। সুতরাং ২০১৬ সালের নভেম্বরের নোট বাতিল এবং ২০১৭-র জিএসটি ভারতীয় অর্থনীতির, বিশেষত সাধারণ মানুষের, উপর কী প্রভাব ফেলিয়াছিল, ভোগব্যয়ের পরিসংখ্যানে সেই আখ্যানটিই ধরা পড়িয়াছে। বাজারে চাহিদা হ্রাসের ফলেই আজ ভারত আর্থিক মন্দার মুখে দাঁড়াইয়া আছে। সুস্থ গতিতে চলা একটি অর্থব্যবস্থায় হঠাৎ চাহিদা এমন মুখ থুবড়াইয়া পড়িল কেন, সেই প্রশ্নের উত্তরে যদি সরাসরি তাঁহাদের দিকে আঙুল উঠে, নরেন্দ্র মোদীদের তাহা ভাল না লাগাই স্বাভাবিক। অতএব, পরিসংখ্যান বাতিল।

বাতিল পরিসংখ্যান বলিতেছে, গ্রামাঞ্চলে ভোগব্যয় হ্রাস পাইয়াছে প্রায় নয় শতাংশ; শহরে বাড়িয়াছে দুই শতাংশের কাছাকাছি। কৃষি এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের গায়ে ধাক্কা লাগিলে তাহাই স্বাভাবিক। যে পরিসংখ্যান মোদীরা বাতিল করেন নাই, তাহাতে আরও দুঃসংবাদ আছে। পাইকারি মূল্যসূচকের স্ফীতির হার শূন্যের কাছাকাছি, অর্থাৎ বাজারে চাহিদায় প্রবল ভাটার টান; খুচরা মূল্যসূচকের স্ফীতির হার বিপজ্জনক ভাবে বাড়িতেছে— মানে, মানুষের ভোগক্ষমতা আরও কমিবে। অর্থশাস্ত্রে এই পরিস্থিতির নামই স্ট্যাগফ্লেশন— যুগপৎ মন্দা এবং মূল্যস্ফীতি। ভারতের ন্যায় বিপুলায়তন অর্থব্যবস্থা এই কুম্ভীপাকে পড়িলে নিস্তার পাওয়া দুষ্কর। অর্থব্যবস্থার চালকের আসনে যাঁহারা বসিয়া আছেন, অর্থশাস্ত্রে তাঁহাদের জ্ঞান ও পারদর্শিতা যদি নামমাত্রও না হয়, বাঁচাইবে কে? অনেকেই বাঁচাইতে পারিতেন, যদি না শাসকের অহঙ্কার এমন গগনচুম্বী হইত, যদি না সমালোচনা শুিনলেই তাঁহারা রাষ্ট্রদ্রোহ ভাবিতেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে সম্পূর্ণ অপদার্থ বলিলে হয়তো ঈষৎ অত্যুক্তি হইবে, কিন্তু অর্থনীতি সম্পর্কে অতুলনীয় ‘প্রজ্ঞা’র পাশাপাশি তাঁহার অসামান্য অহঙ্কার এবং সুতীব্র অসহিষ্ণুতা বলিতেছে, ভারতীয় অর্থব্যবস্থার রক্ষা পাওয়া মুশকিল। এখন পরিসংখ্যান চাপিয়া যাওয়াই মুখরক্ষার পথ। কিন্তু এই প্রবঞ্চনা কত দিন চলিতে পারে? হীরকরাজ্যের রাজজ্যোতিষীর ভাষায় বলিলে: যত দিন তত দিন।

Narendra Modi Statistics
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy