Advertisement
E-Paper

রক্তাল্পতা দূর করতে আরও সক্রিয়তা জরুরি

রক্তাল্পতা নিজে একটি অসুখ। আবার অনেক অসুখের কারণও। ছোটবেলা থেকেই শিশুদের যত্ন নিলে ভবিষ্যতে রক্তাল্পতার আশঙ্কা অনেকটাই দূর করা যায়। লিখছেন লক্ষ্ণণ দাসঠাকুরারক্তাল্পতা নিজে একটি অসুখ। আবার অনেক অসুখের কারণও। ছোটবেলা থেকেই শিশুদের যত্ন নিলে ভবিষ্যতে রক্তাল্পতার আশঙ্কা অনেকটাই দূর করা যায়

শেষ আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০২:৩১
ফলিক অ্যাসিডের পাশাপাশি, মিড-ডে মিলে ডিমের মতো প্রোটিন খাওয়াও প্রয়োজন। ফাইল ছবি

ফলিক অ্যাসিডের পাশাপাশি, মিড-ডে মিলে ডিমের মতো প্রোটিন খাওয়াও প্রয়োজন। ফাইল ছবি

বেশ কয়েক বছর আগে, কেন্দ্রীয় সরকারের নানা সমীক্ষায় উঠে এসেছিল, দেশের এক বড় অংশের শিশুর আনাহার এবং অপুষ্টির কথা। শিশুদের সেই অপুষ্টির অভাবের দূর করতে, তখন সরকারের তরফ স্কুলে স্কুলে শুরু হয়েছিল মধ্যাহ্নকালীন আহার বা মিড-ডে মিল কর্মসূচি। অপুষ্টি দূর করতে মিড-ডে মিলে পুষ্টিকর খাবার দেওয়ার উপরে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তার পরেও দেখা গিয়েছে, দরিদ্র পরিবারের শিশুরা বেশ কয়েকটি সমস্যায় ভুগছে। এর মধ্যে একটি হল রক্তাল্পতা। এই রক্তাল্পতায় ভোগার কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গিয়েছে, এর একটি বড় অংশের জন্য দায়ী আয়রন ও ফলিক অ্যাসিডের অভাব। এই ফলিক অ্যাসিডের মাত্রা পূর্ণ করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে ২০১২ সালে ‘উইকলি আয়রন ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্টেশন’ (ডব্লিউআইএফএস) কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল। এই কর্মসূচিতে রাজ্য সরকারগুলিও যোগদান করে।

আমাদের রাজ্যে সরকারি ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলগুলির ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণির সব পড়ুয়া এই প্রকল্পের আওতাধীন। প্রতি সপ্তাহের সোমবার সব পড়ুয়াকে স্কুলের তরফ থেকে এই ফলিক অ্যাসিড ট্যাবলেট দেওয়া হয়ে থাকে। নিয়ম অনুযায়ী, সোমবার ছুটি থাকলে, সপ্তাহের পরের কাজের দিনে তা দেওয়া বাধ্যতামূলক। দীর্ঘকালীন ছুটি থাকলে, স্কুল ও সরকারের তরফ থেকে ছুটি পড়ার আগে হিসেব করে পড়ুয়াদের হাতে ট্যাবলেট তুলে দেওয়ার নিয়মও রয়েছে। এই ট্যাবলেট সরবরাহ এবং বিতরণের দায়িত্বে রয়েছে রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্য দফতর। রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর, জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ, ব্লক স্বাস্থ্য বিভাগ এবং উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মাধ্যমে বিদ্যালয়গুলিতে এই কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। পূর্ব বর্ধমান জেলার ২৩টি ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ৭৪টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ৫৯২টি উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং ২১৫টি গ্রাম পঞ্চায়েত এই কাজের সঙ্গে যুক্ত। কী ভাবে হয় এই কাজ? প্রথমেই স্বাস্থ্য দফতর বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রশিক্ষণ দেন। তার পরে, বিদ্যালয়গুলিতে ছাত্রছাত্রীদের জন্য ট্যাবলেটগুলি দেওয়া হয়ে থাকে। এই স্তরে সাফল্যের উপরে জনসংখ্যার ১৮ থেকে ২০ শতাংশের ভবিষ্যৎ জড়িয়ে আছে।

এই কর্মসূচিকে আরও সম্প্রসারিত করার লক্ষে ২০১৮ সালে জিআর ডব্লিউআইএফএস কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এই কর্মসূচি প্রাথমিক স্তরের বিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের জন্যও চালু হয়। এই স্তরে জনসংখ্যার দশ থেকে এগারো শতাংশ রয়েছে। এদের সাধারণত গোলাপি রঙের ট্যাবলেট দেওয়া হয়ে থাকে। এখানে সরবরাহ, প্রশিক্ষণ আগের নিয়ম অনুসারেই হয়ে থাকে। ব্লক স্বাস্থ্য দফতর সরাসরি বিদ্যালয় পরিদর্শকের দফতরের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়কে ট্যাবলেট সরবরাহ করে থাকে। ক্ষেত্র বিশেষ এই আয়রন ট্যাবলেট সরাসরি বিদ্যালয়েও সরবরাহ করা হয়ে থাকে।

কিন্তু এ সম্পর্কে অনেক অভিযোগও রয়েছে। যেমন, অনেকে মনে করেন, এই সরকারি কর্মসূচি চলে অনেকটা যান্ত্রিক ভাবে। অর্থাৎ আন্তরিকতার অভাব রয়েছে। ফলে এই বিরাট কর্মসূচি নেহাতই আনুষ্ঠানিক ভাবে পালিত হয়ে থাকে। অভিযোগ থাকলেও, এটা সব সময়ে মনে রাখার দরকার আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ঠিক ভাবে গড়ে তুলতে হলে এই প্রকল্প রূপায়ণের জন্য সংশ্লিষ্ট সব দফতরকে সচেতন ও আন্তরিক হতে হবে। এই কর্মসূচি কেবল রক্তাল্পতা রোগ দূরীকরণেই সহায়ক নয়, দেশের জন্য একটি সুস্থ ও কর্মঠ প্রজন্ম গড়ে তোলার ভিত্তিও বটে।

রক্তাল্পতার হাত থেকে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করতে হলে স্কুলস্তর থেকেই সচেতনতা গড়ে তোলার প্রয়োজন। তবে স্কুলস্তরে ছাত্রছাত্রীদের নিয়মিত ট্যাবলেট সরবরাহ করেই কর্মসূচি শেষ হয়ে গেলে চলবে না। এই সময় থেকেই পড়ুয়াদের শারীরিক এবং মানসিক বিকাশের দিকে নজর রাখতে হবে। রক্তাল্পতার কারণ ও তার লক্ষণ সম্পর্কে এ জন্য সচেতন থাকা প্রয়োজন শিক্ষক, শিক্ষিকা এবং পড়ুয়াদেরও।

চিকিৎসকেরা রক্তাল্পতার কয়েকটি লক্ষণ চিহ্নিত করেছেন। তাঁদের মতে, রক্তাল্পতার প্রাথমিক উপসর্গগুলি হল দুর্বলতা, পড়াশোনায় মন দিতে সমস্যা, শেখার ক্ষমতা কমে যাওয়া, খেতে ইচ্ছে না করায় বার বার সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়া ইত্যাদি। বিদ্যালয় পড়াশোনা চলার সময়ে কোনও পড়ুয়ার মধ্যে এমন রোগের কোনও উপসর্গ দেখা যাচ্ছে কি না, সে বিষয়ে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের নিয়মিত নজরদারি চালাতে হবে।

চিকিৎসকেরা মনে করেন উপযুক্ত পরিমাণে আনাজ না খাওয়া, শরীরে কৃমি থাকা, ইত্যাদির কারণে পড়ুয়াদের একাংশের মধ্যে সমস্যা দেখা দেয়। পড়ুয়াদের মধ্যে প্রয়োজনীয় খাদ্যোপাদান জোগান দেওয়ার জন্য তাদের খাবারে পালং, পিঁয়াজপাতা, সর্ষে শাক, পুদিনা, প্রভৃতি শাক সুষম মাত্রায় থাকা বাঞ্ছনীয়। তারই সঙ্গে সঙ্গে পড়ুয়াদের মিড-ডে মিলে ছোলা, সোয়াবিন, মাংসের মতো প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবারের উপস্থিতি একান্ত প্রয়োজন। পুষ্টিকর খাবার সরবরাহের পাশাপাশি, খাবারগুলি যাতে পরিচ্ছন্ন ভাবে রান্না করা হয়, সে দিকেও নজর রাখতে হবে। কারণ, অনেক সময় দেখা যায় যে, অপরিচ্ছন্নতার কারণে মানবদেহে নানা রকমের কৃমি প্রবেশ করতে পারে। তার জেরে ঘটতে পারে সংক্রমণও। অনেক সময় কৃমি বা এই জাতীয় সংক্রমণের জন্যও রক্তাল্পতা হতে পারে। নিয়মিত আয়রন ট্যাবলেট পরিবেশনের পাশাপাশি, পড়ুয়াদের কৃমিনাশের জন্য সময় মতো কৃমিনাশক সরবরাহের দিকেও নজর দেওয়া প্রয়োজন। তার সঙ্গে সঙ্গে পড়ুয়াদের নিয়মিত শরীরচর্চার দিকেও নজর রাখা প্রয়োজন।

রক্তাল্পতা নিজে একটি অসুখ। আবার অনেক অসুখকেও আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসে। ছোটবেলা থেকেই শিশুদের প্রয়োজনীয় যত্ন নিলে ভবিষ্যতে রক্তাল্পতার আশঙ্কা অনেকটাই দূর করা যায়। তাই রক্তাল্পতাকে মূল ভিত্তি থেকে দূর করতে বিদ্যালয় স্তর থেকে আরও সক্রিয় হওয়ার সময় এসেছ।

বিসিডিএন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকর্মী

Food Anemia Disease
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy