Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

পড়ুয়াদের স্বার্থ জড়িত এমন সব প্রকল্পেই নজর বাড়ুক

‘নির্মল বিদ্যালয় সপ্তাহ’ পালন সদর্থক ভাবনা। সপ্তাহভর পরিচ্ছন্নতার পাঠ নিচ্ছে ছাত্রছাত্রীরা। এর চেয়ে ভাল আর কী হতে পারে? পরিচ্ছন্ন শৈশবই পারে পরিচ্ছন্ন দেশ গড়তে।

‘নির্মল বিদ্যালয় সপ্তাহ’ পালন। বিষ্ণুপুরে। নিজস্ব চিত্র

‘নির্মল বিদ্যালয় সপ্তাহ’ পালন। বিষ্ণুপুরে। নিজস্ব চিত্র

রামামৃত সিংহ মহাপাত্র
শেষ আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০১:০২
Share: Save:

২৬-৩১ অগস্ট রাজ্যের স্কুলগুলিতে পালিত হল ‘নির্মল বিদ্যালয় সপ্তাহ’। উদ্দেশ্য, স্কুল প্রাঙ্গণ পরিষ্কার রাখা, প্লাস্টিক বর্জন, বৃক্ষরোপণ, স্বাস্থ্যবিধি মানা, শৌচাগারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং তা জনমানসে ছড়িয়ে দিয়ে পরিচ্ছন্ন সমাজ গঠনে সাহায্য করা। ছাত্রছাত্রীরা সুস্থ সমাজ গঠনের প্রয়োজনীয়তা এবং পদ্ধতি শুধু শিখবেই না, সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষকে তা জানাতেও ভূমিকা নেবে।

‘নির্মল বিদ্যালয় সপ্তাহ’ পালন সদর্থক ভাবনা। সপ্তাহভর পরিচ্ছন্নতার পাঠ নিচ্ছে ছাত্রছাত্রীরা। এর চেয়ে ভাল আর কী হতে পারে? পরিচ্ছন্ন শৈশবই পারে পরিচ্ছন্ন দেশ গড়তে। অনেকেরই মত, মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি শেখানো বা সামাজিক ভাবে সচেতন করার যে কাজে প্রশাসন এখনও পুরোপুরি সফল নয়, সেখানে ছাত্রছাত্রীরা অনেক বেশি কার্যকর হতে পারে।

বাড়ি বাড়ি, দোকান-বাজার ঘুরে এই কাজটিই সুন্দর ভাবে করেছে ছাত্রছাত্রীরা। জনে জনে বোঝাচ্ছে, মাঠে-ঘাটে শৌচ করা মানে কেন মৃত্যু-পরোয়ানা ডেকে আনা, প্লাস্টিক বর্জন কেন জরুরি, গাছ লাগালে কেমন করে প্রাণ বাঁচে, খাওয়ার আগে কেন ও কেমন করে হাত ধুতে হবে এবং এমনই আরও ছোট ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভাল থাকার পন্থা। পড়ুয়াদের এই পাঠদান সবাই যে মেনে নিচ্ছেন এমনটাও নয়। কিন্তু যখন নিজের পাড়া বা ঘরের ছেলে বা মেয়েটি বলছে খাবার আঢাকা থাকছে বলেই আর পাঁচটা পরিবারের চেয়ে রোগ-জ্বালায় বেশি ভুগতে হচ্ছে, তখন তাঁরাও ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন। নীরোগ থাকার জন্যই যে জল ছেঁকে খাওয়া উচিত বা নিজেদের ও সমাজের ভবিষ্যতের জন্য জল সংরক্ষণ জরুরি, এই ভাবনা তাঁদের নাড়া দিচ্ছে।

এই ভাবনার জায়গায় সমাজকে পৌঁছে দেওয়াই এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় কাজ। আমরা অবলীলায় প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে প্লাস্টিক-পলিথিন ব্যবহার করছি। আবর্জনা জমিয়ে রাখছি বাড়ির চারপাশে, জমা জল জমিয়ে রাখছি দিনের পর দিন। জেনেও না জানার ভান করে সহায়তা করছি ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া ছড়িয়ে পড়তে। দায় অস্বীকার করছি। দায়ী করছি সরকারকে। অথচ একটু সচেতন হলেই সমাজ রোগমুক্ত হতে পারে। এই সহজ সত্যটাই বাড়ি বাড়ি গিয়ে বুঝিয়ে আসছে পড়ুয়ারা।

কিন্তু যারা এই পরিচ্ছন্নতার পাঠ দিচ্ছে, তারা কতটা পরিচ্ছন্ন পরিবেশ পাচ্ছে তা-ও ভেবে দেখা দরকার। দিনের একটা বড় সময় তারা স্কুলে কাটায়। অথচ অনেক স্কুলে মেয়েদের তো বটেই, ছেলেদেরও ব্যবহারযোগ্য শৌচাগার নেই। যেগুলো আছে, তা ব্যবহারের অযোগ্য। সর্বশিক্ষার দৌলতে স্কুলগুলিতে শ্রেণিকক্ষ বা শিক্ষা সরঞ্জামের অভাব অনেকটা মিটলেও অবহেলিত থেকে গিয়েছে শৌচাগারের বিষয়টি। বিশেষত শুধু শৌচাগার না থাকা বা ব্যবহারযোগ্য শৌচাগারের অভাবে ছাত্রীরা ঋতুকালীন সময়ে স্কুলে আসার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। সাময়িক বা স্থায়ী ভাবে স্কুলছুট হয়েছে, এমন ঘটনাও বিরল নয়। তা ছাড়া, অপরিচ্ছন্ন শৌচাগার ব্যবহারে রোগব্যাধির আশঙ্কা বাড়ে। অসুস্থ শরীরে পড়াশোনায় বাধা পড়বে। প্রশাসন শৌচাগার তৈরি এবং সেগুলো নিয়মিত সাফাইয়ের ব্যবস্থা করলে স্কুলে পরিচ্ছন্ন পরিবেশ পাবে ছাত্রছাত্রীরা। তাতে তারা নিয়মিত স্কুলে আসতে পারবে, নীরোগ শরীর পড়াশোনারও সহায়ক হবে।

এই প্রসঙ্গে আসে মিড-ডে মিলের কথাও। মনে রাখতে হবে, পুষ্টিকর খাবার যতটা জরুরি, ততটাই দরকারি পরিষ্কার বা পরিচ্ছন্ন ভাবে খাবার খাওয়া। এখানে মিড-ডে মিল রান্না করা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলা ও দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকদের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পদ্ধতি মেনে কী ভাবে হাত ধুতে হয়, তা ছাত্রছাত্রীরা শিখিয়ে দিচ্ছে ওই মহিলাদের। শিশু সংসদ বাধ্য করছে খাবার জায়গা ও রান্নার জায়গা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে। কাজটা করছে ছাত্রছাত্রীরা। তাদের শিখিয়ে দিচ্ছেন শিক্ষকেরা। স্বাস্থ্য-বিধানের পাঠ দেওয়া বা নেওয়ার ক্ষেত্রে ঘাটতি থেকে গেলে মুশকিল। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই শিক্ষকদের সচেতন হতে হবে। নজর রাখতে হবে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে খাবার আগে শিশুরা হাত ধুচ্ছে কিনা। নিয়মিত নখ কাটছে কি না।

প্রশ্ন উঠতে পারে, পাঠ্যবইয়ের সিলেবাসের বাইরে শিক্ষক-শিক্ষিকারা এ সব করতে যাবেন কেন। এখানেই অন্য পেশার মানুষদের সঙ্গে শিক্ষকদের ফারাক। দেহ ও মন সুস্থ না থাকলে কেউই শিক্ষায় মনোযোগী হতে পারে না। আর শিশুদের সুশিক্ষা দেওয়াই তো শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রধান কাজ। শুধু পুথিগত শিক্ষা নয়, সামগ্রিক ভাবে সুস্থ সমাজ-দেশ গঠনের জন্য যে শিক্ষা প্রয়োজন তার সবটাই এতে অন্তর্ভুক্ত।

শুধু নির্মল বিদ্যালয় গঠনই নয়, ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থ জড়িত এমন সব প্রকল্পেরই সফল রূপায়ণে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের আগ্রহী হওয়া একান্ত আবশ্যক। তা সে কৃমিনাশক ওষুধ হোক বা রক্তাল্পতা দূরীকরণে আয়রন ট্যাবলেট বিলি। আর এই পাঠ শুধু শিক্ষার্থী স্তরে সীমাবদ্ধ রাখলেই হবে না। ছড়িয়ে দিতে হবে অভিভাবকদের মধ্যেও। তবে এই সাত দিনের কর্মসূচি পরিচ্ছন্নতার শুরুর দিন হিসেবে ধরতে হবে। নিয়মিত ব্যবহারে এটিকে অভ্যাসে পরিণত করতে হবে। তবেই উদ্দেশ্য সফল হবে। গড়ে উঠবে সুস্থ, সবল, নীরোগ সবুজ সমাজ।

লেখক সিমলাপালের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Nirmal Vidyalaya Student School Drop Out
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE