Advertisement
E-Paper

দিনটা পেরোলে কী হবে

অনেক গভীর থেকে উঠে এসেছে কথাগুলো। কারণ এ দেশের অধিকাংশ প্রতিবন্ধী মানুষই দরিদ্র এবং সামাজিক ও পারিবারিক বৈষম্য ও অবহেলার শিকার।

মৌলীমাধব ঘটক

শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:১৭

গত বছর ৩ ডিসেম্বর, মানে বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবসে হাওড়া শ্যামপুরের বাসিন্দা জন্মান্ধ দুধকুমারের গলার আক্ষেপটা এখনও মনে পড়ে— প্রায়ই মনে হয়, এই দেশে লোকে ভাবে মেয়ে হলে অভিশাপ, আর আমরা ভাবি, ছেলে না হয়ে একটা সুস্থ মেয়ে হলে ভাল হত। অন্তত কন্যাশ্রীর টাকাটা পেয়ে দাঁড়াতে পারতাম। এ ভাবে গান গেয়ে ভিক্ষে করতে হত না।

অনেক গভীর থেকে উঠে এসেছে কথাগুলো। কারণ এ দেশের অধিকাংশ প্রতিবন্ধী মানুষই দরিদ্র এবং সামাজিক ও পারিবারিক বৈষম্য ও অবহেলার শিকার। কার্যত তাঁরা একলা। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পরে পরিবার মানে, দাদা, ভাই, বোন— এরা কিছু সময় হয়তো সহানুভূতি নামক দুর্লভ গুণ পরিবেশন করলেও আসলে দিনে দিনে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যায়।

১৯৯৫ সালের পর ২০১৬-তে নতুন করে ঢেলে সাজা হয়েছে ভারতীয় ডিসএবিলিটি অ্যাক্ট। সেখানে সাত ধরনের প্রতিবন্ধকতার বদলে একুশ ধরনের শারীরিক ও মানসিক রোগ ও সমস্যাকে প্রতিবন্ধী তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এদের সামাজিক সুরক্ষা, সুযোগ-সুবিধা, মর্যাদা, চিকিৎসা ইত্যাদি নিয়ে বহু কথা খরচ করা হয়েছে। বিধান দেওয়া হয়েছে এদের শিক্ষা, চলাফেরার জন্য বাধামুক্ত পরিবেশ তৈরি করার জন্য এবং পরতে পরতে এদের সামাজিক সম্মান ও সমান অধিকারের বাণীও বর্ণিত হয়েছে।

কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এই উপদেশগুলির কতগুলি পালিত হয়, আমাদের থেকে ওই মানুষগুলোই অনেক ভাল বোঝে। কয়েক দিন আগে কেন্দ্রীয় ‘চিফ কমিশনার ফর দ্য পারসনস উইথ ডিসএবিলিটিস’ কমলেশ কুমার পান্ডে পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে জানান, যেখানে অন্যান্য অনেক রাজ্যে প্রতি প্রতিবন্ধী মাসিক ২৫০০ টাকা ভাতা পান, এই রাজ্যে তা মাত্র ৭৫০ টাকা। বাংলার কুড়ি লক্ষ প্রতিবন্ধীর মধ্যে মাত্র এগারো লক্ষ মানুষ শংসাপত্র পেয়েছেন এবং শংসাপত্র না থাকলে সমস্ত সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে হয় এঁদের। এ ছাড়াও জেলা হাসপাতাল থেকে শংসাপত্র দেওয়ার রীতি অন্যান্য রাজ্যে আছে। অথচ এখানে শুধুমাত্র মেডিক্যাল কলেজগুলিতে মাসে এক দিন বোর্ড বসে এই শংসাপত্র দেওয়ার জন্য। শারীরিক ভাবে প্রতিবন্ধীদের যাতায়াত করার জন্য ও বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-অফিস-আদালতে বিশেষ র‌্যাম্প ও চৌকাঠ-সিঁড়িহীন ব্যবস্থা, যা তাঁদের মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে, সে ব্যাপারেও আধুনিক বন্দোবস্তের বিশেষ কোনও উদ্যোগ চোখে প়ড়ছে না সারা দেশে।

এই দেশে প্রতিবন্ধী মানুষদের প্রায় ৬৯ শতাংশই গ্রামে বাস করেন। অর্থাৎ, ভারতে দু’কোটি আটষট্টি লক্ষ প্রতিবন্ধী মানুষের মধ্যে এক কোটি ছিয়াশি লক্ষ মানুষ গ্রামে বাস করেন। তাঁদের জন্য বিশেষ বাড়ি, স্কুল, যাতায়াতের বিশেষ ব্যবস্থা ও সার্বিক ভাবে তাঁদের স্বাবলম্বী করে তোলার ব্যাপারে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ অত্যন্ত সীমিত। চিকিৎসার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা, যেমন, পা-হাতের সমস্যা থেকে শুরু করে মানসিক ভাবে পিছিয়ে প়ড়া, কথা বলার ক্ষেত্রে অসুবিধা বা চোখ-কান-মস্তিষ্কের অসুখে পঙ্গু হয়ে পড়া মানুষদের জন্য বিনাখরচে আধুনিক চিকিৎসা ও বিশেষ বিশেষ রিহ্যাবিলিটেশন বা পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার যে সার্বিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা, তাতেও অত্যন্ত পিছিয়ে রয়েছে এই দেশ। যেহেতু অনেক ক্ষেত্রেই আধুনিকতম পুনর্বাসন চিকিৎসাতেও প্রতিবন্ধকতা পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয় না, তাই ধীরে ধীরে পরিবার ও সমাজ তাঁকে সমবেদনার জায়গা থেকে অবহেলার অন্ধকারে ঠেলে দেয়। তাঁদের মানবজীবনকে, মনুষ্যত্বকে, মানসিক চাহিদাকে এই সুস্থ সমাজ বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজেরা আত্মস্বার্থে নিমগ্ন থাকে।

আবার একটা প্রতিবন্ধী দিবস ঘটা করে পালিত হবে বহু জায়গায়। সরকারি, বেসরকারি, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে অনেক পাশে থাকার আশ্বাস আসবে। সেরিব্রাল পলসি আক্রান্ত বাচ্চারা মঞ্চে নাচ পরিবেশন করবে। কিন্তু তার পর? তাদের মনে প্রশ্ন থেকেই যাবে, কবে এই রাজ্যের কন্যাদের মতো আমরাও একটা রঙিন সূর্য দেখব! মহামান্য সরকার পারে না, প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ একটি প্রকল্প চালু করতে, দুধকুমার মান্নারা যাতে একটু আলো দেখতে পান?

চিকিৎসক, রিহ্যাবিলিটেশন বিশেষজ্ঞ

discrimination Society Specially abled People
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy