Advertisement
E-Paper

চৌকিদারের শাসন

প্রধানমন্ত্রী কোন অর্থে ‘ডিসিপ্লিন’ কথাটি ব্যবহার করিয়াছেন, তাহা স্পষ্ট নহে। তবে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দুই গোত্রের শাসনের মধ্যে ফারাক করিয়াছিলেন— একটি অভিভাবকের শাসন, আর দ্বিতীয়টি চৌকিদারের শাসন। প্রথমটি অনুশাসন, আর দ্বিতীয়টি শৃঙ্খলা।

শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:১৮
বইপ্রকাশ অনুষ্ঠানে নরেন্দ্র মোদী।ছবি পিটিআই।

বইপ্রকাশ অনুষ্ঠানে নরেন্দ্র মোদী।ছবি পিটিআই।

ফ্রয়েড মুচকি হাসিতেন। এক বইপ্রকাশ অনুষ্ঠানে স্বৈরাচারের প্রসঙ্গ টানিয়া আনিলেন নরেন্দ্র মোদী। কার্যত, হাওয়া হইতে। কেহ তাঁহার দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করেন নাই; পাঁচ মেধাজীবীকে গ্রেফতার করিবার ঘটনাটি কেহ স্মরণ করাইয়া দেন নাই; এমনকি, তাঁহার প্রশাসনই যে খানিক ঘুরপথে তাঁহাকে ফ্যাসিবাদী বলিতেছে, হয়তো ভদ্রতাবশেই কেহ সেই প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন নাই। নরেন্দ্র মোদী নিজেই কথাটি তুলিলেন। বলিলেন, দেশের এমনই অবস্থা যে কেহ সামান্য ‘ডিসিপ্লিন’ আনিতে চাহিলে তাঁহার আর রক্ষা নাই— স্বৈরাচারী তকমা লাগাইয়া হইচই বাঁধিয়া যাইবে। এ ক্ষণে ইংরাজি ‘ডিসিপ্লিন’ শব্দটিকে উদ্ধৃত করিবার কারণ দুইটি। এক, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাঁহার হিন্দি ভাষণে ইংরাজি শব্দটি ব্যবহার করিয়াছেন। দুই, শব্দটিকে বাংলায় অনুবাদ করিলে দুইটি সম্ভাব্য প্রতিশব্দ পাওয়া সম্ভব— অনুশাসন এবং শৃঙ্খলা। শব্দ দুইটি কাছাকাছি, কিন্তু এক নহে। প্রথমটি কাহাকে নিজ কর্তব্যের পথে অবিচলিত থাকিবার কথা বলে। দ্বিতীয়টি ব্যক্তিকে নিয়মের শৃঙ্খলে বাঁধিতে চাহে। প্রথম অর্থে প্রশ্ন করিবার, তর্ক করিবার অবকাশ অসীম। দ্বিতীয়টি তর্ককে ঠাঁই দেয় না। প্রথমটি তর্কশীল ভারতীয় সংস্কৃতির অঙ্গ। দ্বিতীয়টি সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ, অথবা নাগপুরের দর্শন। মুক্তচিন্তার সহিত শৃঙ্খলের ফারাক অনতিক্রম্য।

প্রধানমন্ত্রী কোন অর্থে ‘ডিসিপ্লিন’ কথাটি ব্যবহার করিয়াছেন, তাহা স্পষ্ট নহে। তবে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দুই গোত্রের শাসনের মধ্যে ফারাক করিয়াছিলেন— একটি অভিভাবকের শাসন, আর দ্বিতীয়টি চৌকিদারের শাসন। প্রথমটি অনুশাসন, আর দ্বিতীয়টি শৃঙ্খলা। যিনি স্বঘোষিত ‘প্রধান চৌকিদার’, তিনি কোন শাসনটির কথা বলিয়াছেন, আঁচ করা চলে। ধরিয়া লওয়া যায়, ‘ডিসিপ্লিন’ বলিতে প্রধানমন্ত্রী শৃঙ্খলা বুঝিয়াছেন। জরুরি অবস্থার স্মৃতিচারণ করিতে বসিলে মধ্যবিত্ত ভারতীয় এখনও একটি কথা উল্লেখ করিতে ভুলে না— আহা, তখন রেলগাড়ি সময়ে চলিত। ইহাই শৃঙ্খলা, এবং তাহার প্রতি সাধারণ মানুষের মোহ। ট্রেন সময়ে চলিলে তাহাতে দূষণীয় কিছু নাই, কিন্তু মানুষের যাবতীয় গণতান্ত্রিক অধিকার বেহাত হইবার মূল্যে ট্রেনের সময়ানুবর্তিতা কিনিতে হইলে সেই শৃঙ্খলাকে প্রত্যাখ্যান করাই বিধেয়। কিন্তু, আপাতত ট্রেন নহে, বিবেচ্য মানুষ। নরেন্দ্র মোদীও মানিবেন, উভয়ের মধ্যে ফারাক আছে। দুই লাইনের উপর প্রশ্নহীন গতিতে দৌড়াইয়া চলা মনুষ্যধর্ম নহে। মানুষ প্রশ্ন করিতে চাহে, ভিন্নমতের সহিত তর্ক করিতে চাহে। ডিসিপ্লিনের দোহাই দিয়া সেই পরিসরটিকে অস্বীকার করিতে চাহিলে তাহাতে স্বৈরাচারের গন্ধ পাওয়া যাইবেই। নরেন্দ্র মোদীও যে পাইয়াছেন, তাহাতে আশা হয়, ভারতের গণতান্ত্রিক উত্তরাধিকারটিকে তিনি নিজের চেতনা হইতেও এখন অবধি সম্পূর্ণ মুছিয়া ফেলিতে পারেন নাই।

অনুশাসনের সহিত গণতন্ত্রের বিন্দুমাত্র বিরোধ নাই। বস্তুত, অনুশাসন সম্পূর্ণ উবিয়া গেলে যাহা পড়িয়া থাকে, তাহার নাম অ্যানার্কি বা নৈরাজ্য। গণতন্ত্র ও নৈরাজ্যের ফারাক লইয়া ঊনবিংশ শতক হইতে বহু তর্ক হইয়াছে, প্রধানমন্ত্রী পড়িয়া দেখিতে পারেন। কিন্তু, দুইয়ের মধ্যে যে জমিন-আসমান ফারাক, তাহা সেই তর্কে প্রবেশ না করিলেও বোঝা সম্ভব। গণতন্ত্রের সহিত যে ডিসিপ্লিনের দ্বন্দ্ব, তাহা শৃঙ্খলার ডিসিপ্লিন। অর্থাৎ, প্রশ্নহীন আনুগত্যবাচক ডিসিপ্লিন। নেতা যাহা বলিয়া দিবেন, বিনা সংশয়ে তাহা মানিয়া চলার, দুই লাইনের উপর অন্তহীন দৌড়ের ডিসিপ্লিন। গণতন্ত্র এই প্রশ্নহীন আনুগত্যের পরিসর নহে। সমস্যা হইল, নাগপুরের দর্শন এই প্রশ্নের পরিসরটিকে বুঝিতেই অক্ষম। নরেন্দ্র মোদীও যেমন বুঝিতে পারেন না, ক্রমেই তাঁহার ‘স্বৈরাচারী’ পরিচয়টি এমন সর্বব্যাপী হইয়া উঠিতেছে কেন। গণতন্ত্রের সহিত আর খানিক পরিচয় থাকিলে হয়তো বুঝিতেন।

Narendra Modi Dictatorship নরেন্দ্র মোদী
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy