Advertisement
E-Paper

মন নাই, কুসুম?

‘নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন’-এর ইতিহাসও তিনি জানেন না, মানা মুশকিল। তাহার পরও তিনি যখন বাঁধটিকে ‘দেশের উদ্দেশে’ নিবেদন করিবার কথা ঘোষণা করেন, তখন ধরিয়া লইতে হয়, এই বাঁধ যাঁহাদের বাসস্থান কাড়িয়া লইয়াছে, এবং আরও লইবে বলিয়া আশঙ্কা, সেই মানুষদের তিনি ‘দেশ’-এর অংশ বলিয়া বিবেচনা করেন না।

শেষ আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০০:২০

দেশের প্রধানমন্ত্রী আর তাঁহার হওয়া হইল না। অথবা, ‘দেশ’ বলিতে তিনি যতটুকু বোঝেন, নরেন্দ্র মোদী শুধু সেটুকুরই প্রধানমন্ত্রী হইয়াছেন। গুজরাতে সর্দার সরোবর বাঁধ উদ্বোধন করিবার সময় তিনি আরও এক বার এই কথাটি প্রমাণ করিলেন। কয়েক শত মাইল দূরে, মধ্যপ্রদেশে, বহু মানুষ নর্মদার তীরে ‘জল সত্যাগ্রহ’ করিতেছেন, কথাটি তিনি জানিতেন না বলিয়া বিশ্বাস হয় না। এই বাঁধের জলে মধ্যপ্রদেশে ৪০,০০০ পরিবার ভাসিয়া যাইবে বলিয়া আশঙ্কা। ‘নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন’-এর ইতিহাসও তিনি জানেন না, মানা মুশকিল। তাহার পরও তিনি যখন বাঁধটিকে ‘দেশের উদ্দেশে’ নিবেদন করিবার কথা ঘোষণা করেন, তখন ধরিয়া লইতে হয়, এই বাঁধ যাঁহাদের বাসস্থান কাড়িয়া লইয়াছে, এবং আরও লইবে বলিয়া আশঙ্কা, সেই মানুষদের তিনি ‘দেশ’-এর অংশ বলিয়া বিবেচনা করেন না। সত্য হইল, বৃহৎ বাঁধ মানেই তাহা বহু গ্রাম, বহু জনপদকে ভাসাইয়া লইবে। কাজেই, যিনিই উদ্বোধন করুন, বাঁধের এই অনিবার্য ধ্বংসলীলা তাঁহার নিয়ন্ত্রণের অতীত। নরেন্দ্র মোদী নিমিত্তমাত্র। এবং, সর্দার সরোবর প্রকল্পটির যখন সূচনা হয়, তখনও তিনি নিতান্ত বালক— কমিকস-এর ভাষায়, বাল নরেন্দ্র। সেই প্রকল্পের দায় তাঁহার উপর বর্তায় না। কিন্তু, উদ্বোধনের মঞ্চে দাঁড়াইয়া বুকের ছাতি ফুলাইলে সেই সচেতনতার অভাবের দায় যে তাঁহাকে লইতেই হইবে। যাঁহাদের সর্বস্ব ভাসিয়া গেল, তাঁহাদের সম্পূর্ণ ভুলিয়া যদি ‘দেশ’-এর ছবি আঁকিয়া ফেলেন, তবে সেই দায় না লইয়া উপায় কী?

অথচ, তাঁহার বলিবার মতো অনেক কিছুই ছিল। সর্দার সরোবর বাঁধ প্রকল্পটি বহু দিনের, এবং তাহা বহু দূর অগ্রসর হইয়াই ছিল, ফলে সেই প্রকল্প হইতে পিছাইয়া আসা সম্ভব ছিল না— এই কথাটি জানাইয়া প্রধানমন্ত্রী বলিতে পারিতেন, এই প্রকল্পের ফলে যাঁহাদের ক্ষতি হইল, তিনি তাঁহাদের পার্শ্বে থাকিবেন। তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের সহিত আলোচনার পরিসরটি খুলিতে পারিতেন, সুষ্ঠু পুনর্বাসনের দাবিটিকে যথাযথ মর্যাদা দিতে পারিতেন। তাহাতে অন্তত এই কথাটুকু বোঝা যাইত, ‘উন্নয়ন’-এর কোপ যাঁহাদের উপর পড়ে, প্রধানমন্ত্রী তাঁহাদেরও ‘দেশ’ বলিয়াই ভাবেন। কিন্তু, তিনি উচ্ছেদ হওয়া আদিবাসীদের ‘আত্মত্যাগ’-এর কথা বলিয়াই দায় সারিলেন। জওহরলাল নেহরু ১৯৫৭ সালে পাঞ্চেত বাঁধের উদ্বোধন করাইয়াছিলেন বুধনি মেঝন নাম্নী এক আদিবাসী রমণীকে দিয়া। সম্ভবত, তাঁহাদের ‘আত্মত্যাগ’-এর স্মরণেই। তাহার পর ছয়টি দশক কাটিয়া গিয়াছে। নরেন্দ্র মোদী বুঝাইয়া দিলেন, রাষ্ট্র যাঁহাদের সর্বস্ব কাড়িয়া লয়, তাঁহাদের ‘আত্মত্যাগ’-এর মূল্য, রাষ্ট্রের চোখে, শুষ্ক কথার অধিক বাড়ে নাই।

মধ্যবর্তী ছয়টি দশক অবশ্য জরুরি। কারণ, নেহরু যখন বাঁধগুলিকে ‘আধুনিক ভারতের মন্দির’-এর স্বীকৃতি দিতেছিলেন, তখন গোটা দুনিয়াতেই চোখ ধাঁধানো বাঁধ নির্মাণ ছিল আর্থিক উন্নয়নের সমার্থক। তাহার পর ক্রমে স্পষ্ট হইয়াছে, বাঁধে লাভ যত, ক্ষতি সম্ভবত তাহার অধিক। এমনকী, বিশ্ব ব্যাংকও বৃহৎ বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পগুলি হইতে পিছাইয়া গিয়াছিল। প্রধানমন্ত্রী তাঁহার ভাষণে বিশ্ব ব্যাংকের প্রসঙ্গ টানিয়াছেন। কিন্তু, ব্যাংক কেন সর্দার সরোবর হইতে সরিয়া গিয়াছিল, সেই কারণটি বলেন নাই, হয়তো ছাতি ফুলাইতে ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন। অবশ্য, ‌‘উন্নয়ন’ বলিতে তিনি যাহা বোঝেন, বাঁধ নির্মাণের আখ্যান তাহার সহিত খাপে খাপে মিলিয়া যায়। অতএব, কাহাদের ঘর ভাসিল, কাহাদের জীবিকা ডুবিয়া গেল বাঁধের জলে, সেই কথা তাঁহার মনে ঠাঁই না পাওয়াই স্বাভাবিক। আর, তাঁহাদের কথা ভাবিয়া উচ্ছ্বাসে রাশ টানা? সে অন্য সাধনার ফল।

Narendra Modi Prime Minister Gujarat Sardar Sarovar Dam Birthday নরেন্দ্র মোদী
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy