ধুম লেগেছে। প্রথমে হল সর্দার বল্লভভাই পটেল: এই মুহূর্তে বিশ্বের উচ্চতম মূর্তি। ১৮২ মিটার। খরচ তিন হাজার কোটি টাকা। জোগান দিল কে? সরকার। অর্থাৎ দেশের মানুষ। নর্মদার দ্বীপে জেগে থাকা এই মূর্তি গড়বার সময় বাধা এসেছিল অঞ্চলের জনজাতিদের তরফে। কে শোনে? ব্রিটিশ সরকারও শোনেনি, মোদী সরকারও যে শুনবে না, জানাই ছিল। অতএব, চিন থেকে ব্রোঞ্জ পাতগুলি ঢালাই করে নিয়ে এসে জোড়া লাগানো, ধুমধাম করে মূর্তির উদ্বোধন সম্পন্ন।
ভাবা গিয়েছিল ল্যাঠা চুকেছে। তখনই জানা গেল এ বার জয় শ্রীরাম। সরযূর তীরে, অযোধ্যা নগরীতে গড়ে উঠছে রামচন্দ্রের মূর্তি। যা উচ্চতায় ছাড়াবে সর্দারকে, ২২১ মিটার। ওইটিই হবে বিশ্বের উচ্চতম। খরচের আন্দাজ করা যেতেই পারে। ব্রোঞ্জমূর্তিটির উচ্চতা ১৫১ মিটার। মাথার উপরে ছাতা ২০ মিটার। যে পাদপীঠে ভগবান দাঁড়াবেন: ৫০ মিটার। যার মধ্যে থাকবে জাদুঘর। উত্তরপ্রদেশের মন্ত্রী-মশাই বলেছেন, সরযূর গতিপথ পাল্টে দেওয়া হবে যাতে শ্রীরামচন্দ্রের চরণ ছুঁয়ে যান তিনি।
এ বার খবরে বারাণসী। জনমতের বিরুদ্ধে গিয়ে, বেশ কিছু প্রাচীন বাড়িঘরদোর ভেঙে চওড়া হতে চলেছে বিশ্বনাথ মন্দির চত্বর। হয়তো কোনও দিন ওই মন্দির চত্বরে গঙ্গার ঘাটে গড়া হবে শিবের মূর্তি! তা হয়তো রামের থেকেও উঁচু হবে। ক্রিকেটের রেকর্ড গড়ার মতোই তো চলেছে মূর্তি গড়া। এই সব কাজে বাধা আসে। এসেছেও। পরম ধরম সংসদের গেরুয়াধারীরা বলে দিয়েছেন রামমূর্তি দিয়ে ভোলানো চলবে না, যেখানে হওয়ার কথা ছিল ওই গোলমেলে জায়গাতেই রামমন্দির চাই। সাধারণের জিজ্ঞাসা, এতগুলো টাকা হাসপাতাল কিংবা স্কুল গড়বার জন্য দিলেই তো ভাল ছিল। কিন্তু সরকার কেন শুনবে এই সব ছেঁদো কথা। তারা ভগবানের আদেশে চলছে! অতএব, টাকা দেবে জনগণ খরচ করবে সরকার, এই সনাতন ব্যবস্থা মানা হচ্ছে।
অযোধ্যার রামের পাল্টা হিসাবে এ-রাজ্য থেকে ঘোষণা হয়ে গেল, রাবণবধের জন্য রাম যার পুজো করেছিলেন আমরা সেই মা দুর্গার পুজো করি, করব। আরও ভাল ভাবে করব। আগামী বছরগুলোয় নিশ্চয়ই দেখা যাবে উন্নততর দুর্গাপুজো, আরও ধুমধাম। রামের থেকেও উঁচু দুর্গামূর্তি বা দুর্গাবাড়ির পরিকল্পনা ভেসে ওঠাও আশ্চর্যের নয়।
সর্দার পটেল, রামচন্দ্র ইত্যাদির যে বিপুল খরচ তার টাকা আম আদমি কি স্বেচ্ছায় দিয়েছে? উত্তর না এবং হ্যাঁ। না, কেননা, যে দেশে বেকারের সংখ্যা বিপুল হারে বেড়ে চলেছে, অর্থনীতি বেহাল, যে দেশের মানুষের এক বড় অংশ নুনভাত খেয়ে টিকে থাকার স্বপ্ন দেখে, চিকিৎসার গড় খরচ যেখানে গড় আয়ের তুলনায় অস্বাভাবিক বেশি, বয়স্ক মানুষেরা যে দেশে চিকিৎসার খরচের ভয় পেতে পেতে মারা যান, সেখানে কোন সুস্থবুদ্ধির মানুষ নিজের টাকায় ঢাউস মূর্তি গড়তে সায় দেবে? এমন চললে দেশের প্রতিটি প্রান্তে পড়ে থাকবে অনাহারক্লিষ্ট, রক্তশূন্য মানুষ। জেগে থাকবে অসংখ্য উচ্চ উচ্চতর উচ্চতম মূর্তি। অনড়, প্রাণহীন।
আবার উত্তর হ্যাঁ-ও হতে পারে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতার রায়ে নির্বাচিত সরকার যা-ই করবে, ধরে নিতে হবে তাতে সংখ্যাগরিষ্ঠের মত আছে।
মনে পড়তে পারে সত্তরের দশকে তাঁর দলের সভ্য-সমর্থক ছাত্র-যুবদের মূর্তিভাঙার সমর্থনে বলা সরোজ দত্তের বক্তব্য। ‘‘...(ব্যারাকপুরে) গান্ধীর মূর্তিকে ভাঙছে মঙ্গল পাঁড়ের মূর্তি গড়ার জন্য।’’ ‘‘...মূর্তি ভাঙছে তারা পাল্টা মূর্তি প্রতিষ্ঠার তাগিদে। গান্ধীর মূর্তি ভাঙছে ঝান্সির রাণীর মূর্তি প্রতিষ্ঠার জন্য। গান্ধীঘাট ভাঙছে তারা মঙ্গলঘাট তৈরীর জন্য।’’ ‘‘যা গড়তে হবে তার বিপরীতকে ভাঙতে হবে এবং এই বিপরীত ভাঙার মধ্য দিয়েই গড়া হয়...’’। ‘‘তাই মূর্তি ভাঙার লড়াই আসলে দুই মূর্তির লড়াই এবং দুই মূর্তির লড়াই আসলে দুই রাজনীতির লড়াই, দুই লাইনের লড়াই, দুই শ্রেণীর লড়াই।’’
সে দিন বামচ্যুত ত্রিপুরায় ‘ভারতমাতা কি জয়’ আওয়াজ তুলে লেনিন মূর্তি ভাঙা হল। কিংবা তারও আগে রাশিয়ায় লেনিন মূর্তি উৎপাটিত হল। এ সব তবে নতুন রাজনীতিরই বিঘোষণা। আগামী সময়ে যদি নকশালরা সর্দার পটেলের মূর্তি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উড়িয়ে দেয়, জনসাধারণের টাকা আক্ষরিক অর্থে নর্মদার জলে ডুবলেও, তা হবে তাদের রাজনৈতিক হুঙ্কার। দলীয় মুখপত্রে আর একটি কথাও লিখেছেন শ্রীদত্ত, ‘‘...নতুন মূর্তি মানেই নতুন রাজনীতি...’’। নকশালপন্থীরা জনগণের নাম নিয়েই মূর্তিভাঙার কার্যক্রম চালিয়েছিল, আজ বিজেপিও আম আদমির নাম নিয়েই মূর্তিগড়ার অভিযান চালাচ্ছে। এই তাদের নতুন রাজনীতি।
গাঁধী-নেহরুর বদলে বল্লভভাই প্রতিষ্ঠার রাজনীতি হল গুজরাতবাসীর ভাবাবেগ উস্কে দেওয়ার রাজনীতি। ক্ষুধা-দারিদ্র-বেকারত্ব-আর্থিক সঙ্কটের মূর্তির বিপরীতে রামের মূর্তি প্রতিষ্ঠায় রামরাজ্যের স্বপ্ন দেখাবার রাজনীতি। যে বিভেদের রাজনীতির দৌলতে তাঁরা ক্ষমতায়, তার দংশন থেকে আপাতত ত্রাণ পাওয়ার রাজনীতি। অতএব, যাঁরা আজ মূর্তি গড়ার পক্ষে গলাবাজি করছেন, তাঁদের জেনে রাখা ভাল তাঁরা আসলে কোনও না কোনও মূর্তি ভাঙার পক্ষেই লড়ছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy