Advertisement
E-Paper

নবজাতক ও নার্সিং হোম

বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসায় নজরদারি করতে পাশ হল নতুন আইন। অভিযোগের দ্রুত নিষ্পত্তি করতে কমিশনও তৈরি হল। কিন্তু এ-ই কি যথেষ্ট? বিশেষত শিশুদের চিকিৎসায়?

অসীম মল্লিক

শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০১৭ ০১:০৭

বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসায় নজরদারি করতে পাশ হল নতুন আইন। অভিযোগের দ্রুত নিষ্পত্তি করতে কমিশনও তৈরি হল। কিন্তু এ-ই কি যথেষ্ট? বিশেষত শিশুদের চিকিৎসায়?

বেসরকারি হাসপাতালে যে সব কারণে চিকিৎসার খরচ বাড়ে, শিশু ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তার অনেকগুলিই ধরতে পারেন না বাবা-মা। ধরতে পারার কথাও নয়। দামি হাসপাতালের নামী চিকিৎসক যা বলবেন, সেটাই তাঁরা মেনে নেবেন, এটাই প্রত্যাশিত। তাই ডাক্তাররা যখন বলেন, সদ্যোজাতের জন্ডিস রয়েছে, নীল আলোর তলায় রাখা দরকার যত ক্ষণ না বিলিরুবিন কমছে, এক কথায় রাজি হয়ে যান বাবা-মা। তাঁদের জানার কথা নয় যে বিলিরুবিনের স্তরটাই একমাত্র বিচার্য নয়। গর্ভের কত সপ্তাহে শিশু জন্মেছে, তার বয়স, ওজন, এমন নানা সূচকের নিরিখে ঝুঁকি নির্ণয় হয়। তার উপর নির্ভর করে ফোটোথেরাপির প্রয়োজন, আর তার মেয়াদ। সেই প্রক্রিয়ায় না গিয়ে বহু হাসপাতালে ফোটোথেরাপি চালানো হয় দশ-পনেরো দিন। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ফোটোথেরাপি নিয়ে কোনও সমীক্ষা যদি হয়, তা হলে অকারণ ও অতিরিক্ত ব্যবহারের ছবিটা ধরা পড়বে বলেই আমার বিশ্বাস। কিন্তু একে ‘ভ্রান্ত চিকিৎসা’ বলে নির্ণয় করা অভিভাবকদের পক্ষে সম্ভব নয়।

যে বিষয়গুলি সাধারণ বুদ্ধিতে ধরা যায়, সেগুলোও অভিভাবকরা খেয়াল করেন কি? মায়ের দুধের যে বিকল্প হতে পারে না, সে কথা বহু দিন প্রচার হচ্ছে। কিন্তু বড় বড় হাসপাতাল-নার্সিং হোমে এখনও মাকে কিছু জিজ্ঞাসা না করেই শিশুকে কৌটোর দুধ খাওয়ানো শুরু করিয়ে দেওয়া হয়। বোতল থেকে দুধ যে ভাবে মুখে আসে, তাতে ঠোঁট দিয়ে চাপ দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। স্তন্যপানে তেমন চাপ দেওয়া প্রয়োজন। বোতলে দুধ খাওয়া শুরুর পর বহু শিশু তাই স্তন্যপানের সহজাত ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। শিশুর জন্মের পর প্রথম ছয় মাসে শুধুমাত্র স্তন্যপান এ রাজ্যে বেসরকারি হাসপাতাল, নার্সিং হোমে এখনও নিয়ম নয়, ব্যতিক্রম।

সাম্প্রতিকতম চিকিৎসা, উচ্চতম প্রযুক্তি পাওয়ার জন্য সাধ্যের অতিরিক্ত খরচ করেও বেসরকারি হাসপাতালে যান অনেকে। দুঃখের বিষয়, প্রসূতি ও নবজাতক-সংক্রান্ত যে সব প্র্যাকটিস অনুসরণ করছে বেসরকারি হাসপাতাল, সেগুলো সেই ষাট-সত্তরের দশকের রীতিনীতি। যেমন, প্রসবের পর মাকে নিয়ে যাওয়া হয় কেবিন বা ওয়ার্ডের বে়ডে, আর নবজাতক চলে যায় নার্সারিতে। আত্মীয়রা মহানন্দে কাচের জানলা দিয়ে দেখেন, অনেকগুলো বেডে অনেক কাপড়-মোড়া শিশুদেহের মধ্যে তাদেরটিও শুয়ে। একলা। এটা নিয়মের সম্পূর্ণ বিপরীত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দু’দশক আগে বলে দিয়েছে, মায়ের গায়ের সঙ্গে শিশুর সংযোগ, (‘স্কিন টু স্কিন কনট্যাক্ট’) শিশুর অধিকার। নাড়ি কাটার পরেই মায়ের বুক-পেটের সঙ্গে শিশুর বুক-পেট ঠেকিয়ে শুইয়ে রাখতে হবে অন্তত এক ঘণ্টা। শিশুর ওজন আড়াই কিলোগ্রামের কম হলে আরও অনেকটা বেশি সময় এ ভাবে রাখতে হবে। মায়ের শরীরের উত্তাপ শিশুকে সতেজ করবে, স্তন্যপান তাকে সুরক্ষা জোগাবে। মা অস্ত্রোপচারের ফলে অচৈতন্য থাকলেও এই ‘ক্যাঙারু’ পদ্ধতি অনুসরণ সম্ভব।

কিন্তু কর্পোরেট হাসপাতাল থেকে জেলার নার্সিং হোমগুলির বেশ কয়েকটিতে এই গোড়ার কাজটা করা হচ্ছে না বলে ইঙ্গিত মিলছে। অথচ এই নিয়ম মানলে বহু শিশুকে ‘নিওনেটাল ইনটেন্সিভ কেয়ার ইউনিট’-এ ঢুকতে হত না। বাবা-মাকে চড়া বিল চোকাতে হত না। ভাবতে করুণা হয় যে দামি হাসপাতালে শিশুটি তার অধিকার ও সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যেখানে সরকারি হাসপাতালে জন্মানো দরিদ্র শিশু সাধারণত তা পাচ্ছে। কারণ, মেডিক্যাল কলেজ ও জেলা হাসপাতালগুলিতে ক্যাঙারু পদ্ধতি এখন বাঁধাধরা নিয়ম।

আর একটি উদ্বেগের বিষয় অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার। ইনটেন্সিভ কেয়ার ইউনিটে সংক্রমণের ভয় থাকে। নিয়ম হল, ‘সেনসিটিভিটি টেস্ট’ করে বুঝে নিতে হবে কোন অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করবে, তার পর সেটিই দিতে হবে। অপ্রয়োজনীয় ওষুধ দিলে কিছু অ্যান্টিবায়োটিকে শিশুর প্রতিরোধ তৈরি হয়ে যাবে, সেই ঝুঁকি থাকে। বেসরকারি হাসপাতালে প্রায়ই দেখা যায়, শিশু ঢুকলেই চার-পাঁচ রকম অ্যান্টিবায়োটিক শুরু করে দেওয়া হয়। ডাক্তারদের মনোভাব হল, ‘এখন তো বাঁচুক, প্রতিরোধ তৈরি হলে তখন দেখা যাবে।’
এ-ও প্রোটোকলের বিরোধী। জীবনদায়ী ওষুধে প্রতিরোধ নিয়ে জীবনযাত্রা শুরু করবে একটি শিশু, এ কেমন সিদ্ধান্ত?

সুচিকিৎসায় সদ্যোজাতের অধিকার অগ্রগণ্য। চিকিৎসা নিয়ে অভিযোগের দ্রুত নিষ্পত্তি সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার এক প্রধান উপায়। কিন্তু সেটাই যথেষ্ট নয়। আজ সুচিকিৎসার গোড়ার কথা হল প্রোটোকল মেনে চিকিৎসা। শুধু নালিশ, নজরদারিতে তা হয় না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেই নিশ্চিত করতে হবে যে প্রোটোকলের অনুসরণ করা হচ্ছে তাঁদের প্রতিষ্ঠানে।

নবজাতক বিশেষজ্ঞ, নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপক

Newborn Nursing Home
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy