Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

নতুন দল কি বিজেপিকে দমাতে পারবে

নীতীশ কুমার ও লালুপ্রসাদ হাত মেলানোর ফলে বিহারের রাজনীতিতে যে অভাবনীয় মোড় এসেছে, তার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তাঁদের নিজেদের সমর্থকদের মধ্যে, মুসলিম ও বিভিন্ন জাতের মধ্যে এই ‘বন্ধুত্ব’কে দাঁড় করানোর ক্ষমতার উপর।বছর বাইশ আগে যখন লালুপ্রসাদ যাদবের শাসনের ধরনে বিরক্ত হয়ে নীতীশ কুমার জনতা দলের সঙ্গে সংস্রব ত্যাগ করেছিলেন, তখন কেউ ভাবতেও পারেনি, তাঁরা ফের কাছাকাছি আসবেন। নীতীশের নিজের সংযুক্ত জনতা দল বিজেপিকে জোটসঙ্গী করে লালুপ্রসাদের রাষ্ট্রীয় জনতা দলের বিরুদ্ধে লড়ে, এবং পটনার মসনদ দখল করেছিল। ২০১৫ সালে তাঁদের রাজনীতি প্রায় অভাবনীয় মোড় নিল।

অগত্যা। নতুন জনতা পরিবারের দুই নেতা নীতীশ কুমার ও লালুপ্রসাদ যাদব।

অগত্যা। নতুন জনতা পরিবারের দুই নেতা নীতীশ কুমার ও লালুপ্রসাদ যাদব।

চিন্ময় কুমার
শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০১৫ ০০:১৭
Share: Save:

বছর বাইশ আগে যখন লালুপ্রসাদ যাদবের শাসনের ধরনে বিরক্ত হয়ে নীতীশ কুমার জনতা দলের সঙ্গে সংস্রব ত্যাগ করেছিলেন, তখন কেউ ভাবতেও পারেনি, তাঁরা ফের কাছাকাছি আসবেন। নীতীশের নিজের সংযুক্ত জনতা দল বিজেপিকে জোটসঙ্গী করে লালুপ্রসাদের রাষ্ট্রীয় জনতা দলের বিরুদ্ধে লড়ে, এবং পটনার মসনদ দখল করেছিল। ২০১৫ সালে তাঁদের রাজনীতি প্রায় অভাবনীয় মোড় নিল। সংযুক্ত জনতা দল আর রাষ্ট্রীয় জনতা দল মিশে গিয়ে তৈরি হল জনতা পরিবার। সে পরিবারে অবশ্য অন্য সদস্যরাও আছে— সমাজবাদী পার্টি, ভারতীয় জাতীয় লোক দল আর জনতা দল (সেকুলার)। অর্থাৎ, লালুপ্রসাদ আর নীতীশ যে ফের ঘনিষ্ঠ হলেন, সেটা নিছক জোটসঙ্গী হিসেবে নয়, একেবারে একই দলের সহকর্মী হিসেবে।

প্রশ্ন উঠবে, জনতা পরিবারের নতুন জন্মে বিহারের রাজনীতিতে আখেরে কার লাভ? গোড়াতেই বলে রাখা ভাল, নিজস্ব দলের পৃথক রাজনৈতিক সত্তা মুছে নতুন পরিবারের সদস্য হতে নীতীশ কুমার গোড়া থেকেই উদগ্রীব ও তৎপর ছিলেন। আর, এই মিলনকে যত দিন সম্ভব পিছিয়ে দেওয়ার জন্য প্রচুর চেষ্টা করেছিলেন লালুপ্রসাদ। নীতীশ কুমার কেন লালুপ্রসাদের হাত ধরতে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন? প্রশ্নটা তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ নীতীশ তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বহু চেষ্টায় নিজেকে যে ‘বিকাশ পুরুষ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন, লালুপ্রসাদের সঙ্গে রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতায় সেই ভাবমূর্তি জোর ধাক্কা খাবে বলেই অনেকের ধারণা।

বিহারের বিধানসভা নির্বাচনে জনতা পরিবার মুখ্যমন্ত্রী পদে নীতীশ কুমারের নামই প্রস্তাব করবে বলে অনুমান। গোখাদ্য কেলেঙ্কারিতে নাম জড়িয়ে যাওয়ায় লালুপ্রসাদের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার উপায় নেই। নীতীশের মাপের কোনও রাজনীতিক তাঁর দলে দ্বিতীয় কেউ নেই। কাজেই, নতুন দল তৈরি করার বদলে যদি শুধু জোট হত, তবে নীতীশের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়ায় বাগড়া দেওয়ার কাজটি লালুপ্রসাদের পক্ষে সহজতর হত— জোট ভেঙে দেওয়ার হুমকি দেওয়ার পথ খোলা থাকত তাঁর সামনে। দল ভাঙার কাজটি রাজনৈতিক ভাবে কঠিনতর। অতএব, অনুমান করা চলে, নতুন দলে লালুপ্রসাদের দরকষাকষির ক্ষমতা অপেক্ষাকৃত ভাবে কম।

এই নতুন দল কতখানি মসৃণ ভাবে চলবে, লালুপ্রসাদ আর নীতীশের শিবির কী ভাবে দলের নীতি নির্ধারণের সমীকরণগুলো মেলাবে, এমন অনেক প্রশ্নের উত্তরই এখনও ভবিষ্যতের গর্ভে। কিন্তু, সে প্রশ্নগুলো তুলনায় গৌণ। মূল প্রশ্ন হল, এই দল কি বিহারে বিজেপি-র উত্থানের মোকাবিলা করতে পারবে? দুই দল মিলে গিয়ে নতুন দল তৈরি হওয়া, অথবা দল ভেঙে নতুন দল তৈরি করাকে নিছক দুই দলের ভোট যোগ হয়ে যাওয়া হিসেবে দেখলে বড় ভুল হবে। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের স্তরে নতুন বন্ধুত্ব তৈরি করা তুলনায় অনেক সহজ কাজ। আসল পরীক্ষা হল দলের কর্মী বা সমর্থকদের, বিহারের মতো রাজ্যে নির্দিষ্ট জাতের লোকদের মধ্যে এই বন্ধুত্বকে দাঁড় করানো। তাঁদের পরস্পরের সহযোগী করে তোলা। বলা যায়, এই নতুন দল তৈরির প্রক্রিয়াটি অনেকটা রাসায়নিক বিক্রিয়ার মতো। দুই মৌলের মিলনে নতুন যৌগ তৈরি হবে। সেটা মৌলগুলির তুলনায় শক্তিশালী হবে, নাকি দুর্বল, তা নির্ভর করে সেই বিক্রিয়ায় উপস্থিত অনুঘটকের ওপর।

বিহারে লালুপ্রসাদ-নীতীশের স‌ংযুক্তির ফলে মুসলমান ভোটব্যাঙ্ক একত্র হবে, সেটা নিশ্চিত। রাজ্যের জনসংখ্যার ১৬ শতাংশ মুসলমান। সংখ্যার নিরিখে বেশ গুরুত্বপূর্ণ জনগোষ্ঠী। তা ছাড়া, এই সংযুক্তি রাজ্যের দুই প্রধান অনগ্রসর জাতি, যাদব (রাজ্যের জনসংখ্যার ১১ শতাংশ) আর কুর্মি (৩.৬ শতাংশ)-কে ধরে রাখতে পারবে বলেই অনুমান। বিহারে বহু জাতি অতি অনগ্রসর শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। জাতিগত ভাবে এঁরা মূলত বিভিন্ন গোত্রের কারিগর এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। একক ভাবে কোনও জাতেরই তেমন জনসংখ্যার জোর না থাকলেও সম্মিলিত ভাবে এই অতি অনগ্রসর েশ্রণি বিহারের জনসংখ্যার ৩২ শতাংশ। এত দিন অবধি তাঁরা নীতীশ কুমারের পক্ষে ছিলেন, কারণ নীতীশ তাঁদের জন্য পঞ্চায়েতে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। সম্প্রতি, এই অতি অনগ্রসর শ্রেণির একটা বড় অংশের সমর্থন বিজেপি-র দিকে ঘুরে গিয়েছে। ২০১৪ সালে সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব ডেভেলপিং সোসাইটিজ যে সমীক্ষা করেছিল, তাতে দেখা যাচ্ছে, এই শ্রেণিভুক্তদের অর্ধেক লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি-কে ভোট দিয়েছেন। নরেন্দ্র মোদী নিজে যে অতি অনগ্রসর শ্রেণিভুক্ত, এই কথাটি প্রচার করতে বিহারের বিজেপি ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। এর একটা প্রভাব নিশ্চিত ভাবেই ব্যালটবাক্সে পড়ে। সদ্যগঠিত জনতা পরিবার যদি এই অতি অনগ্রসর শ্রেণির অন্তত কিছুটা সমর্থনও নিজেদের দিকে ফিরিয়ে আনতে পারে, তাদের শক্তি অনেকটা বা়ড়বে। কিন্তু, বিজেপি যদি তাঁদের দিকে চলে-আসা অতি অনগ্রসর শ্রেণির ভোটব্যাঙ্ক ধরে রাখতে পারে, বা বাড়াতে পারে, জনতা পরিবারের কপালে দুঃখ আছে।

জিতনরাম মাঁজির সঙ্গে নীতীশ কুমারের অশান্তি জনতা পরিবারের কাছে অতি অনগ্রসর শ্রেণির গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। মাঁজি মহাদলিত সম্প্রদায়ের লোক। বিহারে এই জনগোষ্ঠী মোট জনসংখ্যার ১২ শতাংশ। ফেব্রুয়ারি মাসে নীতীশ কুমার তাঁকে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া ইস্তক মাঁজি এই সম্প্রদায়ের অবিসংবাদী নেতা হয়ে উঠেছেন। অতএব এই ১২ শতাংশ ভোট নীতীশের হাতছাড়া হচ্ছে, সে আশঙ্কা প্রবল।

মাঁজি সম্ভবত নিজের দল গড়বেন, এবং বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি-র সঙ্গে জোট করবেন। এই জোট হলে বিজেপি বিহারের রাজনৈতিক দৌড়ে বিলক্ষণ প্রাসঙ্গিক থাকবে, এবং তারা লোকসভা নির্বাচনের আগে রামবিলাস পাসওয়ানের লোক জনশক্তি পার্টি আর উপেন্দ্র কুশওয়াহার রাষ্ট্রীয় লোক সমতা পার্টির সঙ্গে যে ‘চরম বৈপরীত্যের জোট’ তৈরি করেছিল, তাতে এক নতুন মাত্রা যোগ করবে। মনে রাখা ভাল, এলজেপি আর আরএলএসপি দলদুটো যে দুই জাতির প্রতিনিধিত্ব করে, সেই পাসওয়ান (জনসংখ্যার ৫ শতাংশ) ও কোয়েরি (৪ শতাংশ) ভোটব্যাঙ্কের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ বেশ দৃঢ়। এই জোটসঙ্গীদের নিয়ে, রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ১৩ শতাংশ উচ্চবর্ণের ভোটব্যাঙ্কে নিজস্ব অধিকার এবং যাদব ও অতি অনগ্রসর শ্রেণির কিছু ভোট সমেত বিজেপি বিহারে জনতা পরিবারের প্রবল প্রতিপক্ষ হয়ে উঠবেই।

বিজেপির সবচেয়ে বড় সুবিধা হল, দল যদি সর্বশক্তিতে অনগ্রসর শ্রেণিকেন্দ্রিক রাজনীতির পথে হাঁটে, তবুও উচ্চবর্ণের ভোটাররা তাদেরই ভোট দেবেন। এই সুবিধাটি থাকার ফলে বিজেপি নীতীশ-লালুপ্রসাদের সমাজবাদী জোটকে একেবারে তাদের মাঠেই চেপে ধরেছে। তার ওপর, বিহারে এই দুই নেতার শাসনকাল যোগ করলে তা প্রায় পঁচিশ বছর হয়। এই দীর্ঘ সময়ে নিশ্চিত ভাবেই বিভিন্ন জনগোষ্ঠী তাঁদের ওপর চটেছে। তারা এক বার বিজেপি-কে বাজিয়ে দেখার কথা ভাবতেই পারেন। কিন্তু এই নতুন দলের সবচেয়ে বড় সমস্যা তার অতীতে। জেডি(ইউ) এবং আরজেডি, উভয় দলই গোটা বিহারে প্রায় সমান ভাবে উপস্থিত। এত দিন অবধি রাজ্যের বহু আসনেই দু’দলের প্রতিষ্ঠিত প্রার্থী ছিল। এ বার সংযুক্ত পরিবারের প্রার্থী স্থির করতে গিয়ে বেশ কিছু আসনে কোনও এক দলকে নিজের প্রতিশ্রুতিমান প্রার্থীকে ছাঁটতে হবে। সেই ছাঁটাই হওয়া প্রার্থী নির্দল হিসেবে, একেবারে সরাসরি বিজেপি-র টিকিটে, ভোটে দাঁড়িয়ে পড়বেন, এমন আশঙ্কা থাকছেই।

কিন্তু, লোকসভা নির্বাচনের রূপকথার দৌড় ফিরিয়ে আনা বিজেপি-র পক্ষেও কঠিন। গত এক বছরে কেন্দ্রীয় সরকার এমন কিছুই করতে পারেনি যাতে আরও এক বার মোদী ঝড় তৈরি করা যায়। এত দিন অবধি যাঁরা বিজেপি-র সমর্থক ছিলেন, তাঁদের একটা অংশ নীতীশকে ভোট দিতে পারেন, কারণ অভিজ্ঞতা তাঁদের শিখিয়েছে, লোকসভা আর বিধানসভা দুটো আলাদা গল্প। নীতীশ কুমার মুখ্যমন্ত্রী হলে
যে বিহারে সুশাসন সম্ভব, তার একেবারে হাতেগরম প্রমাণ রয়েছে। অন্য দিকে, বিজেপি শিবিরে এখনও নীতীশ কুমারের সমতুল্য কোনও নেতা নেই।

মোট কথা, বিহারে জনতা পরিবার আর এনডিএ-র মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের সম্ভাবনা বেশ প্রবল। এখনও অবধি জনতা পরিবার সামান্য হলেও এগিয়ে রয়েছে। কিন্তু, সেই সুবিধা তারা ধরে রাখতে পারবে কি না, এখনও অজানা। এই নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়াটি কত মসৃণ ভাবে উতরোয়, লালুপ্রসাদ এই দফায় নীতীশ কুমারকে ‘বড় ভাই’-এর ভূমিকাটি ছেড়ে দিতে রাজি হন কি না, কিংবা কতটা প্রসন্নমনে রাজি হন এই প্রশ্নগুলোর উত্তরের ওপরই নির্ভর করছে সে রাজ্যে জনতা পরিবার ও বিজেপি-র ভবিষ্যৎ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE