Advertisement
E-Paper

ফেল নেই, অষ্টম শ্রেণিতেও অচেনা অক্ষর

পাশ-ফেল না থাকার কারণে বাবা-মায়েরা ভাবেন, ছেলেমেয়ে তো একটার পরে একটা ক্লাসে দিব্যি উঠে যাচ্ছে। ফেল তো করে না। সন্তানেরা কী শিখল আর কী শিখল না, তা তাঁরা খেয়াল করেন না। লিখছেন জাহাঙ্গীর আলমনবম শ্রেণির রেমিডিয়াল ক্লাসে বাংলা পড়াচ্ছিলাম। বহু দিন পরে এক ছাত্রীকে দেখে রাগ হল। দাঁড়াতে বললাম। দু’হাত ভর্তি চুড়ি। কানে সোনার ঝুমকো

শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০১৯ ০৪:০৭

নবম শ্রেণির রেমিডিয়াল ক্লাসে বাংলা পড়াচ্ছিলাম। বহু দিন পরে এক ছাত্রীকে দেখে রাগ হল। দাঁড়াতে বললাম। দু’হাত ভর্তি চুড়ি। কানে সোনার ঝুমকো। চোখে কাজল। সন্দেহ হতেই প্রশ্ন করলাম, ‘‘বিয়ে হয়ে গিয়েছে?’’ উত্তর এল, ‘‘হ্যাঁ স্যর।’’ তার পরে রেমিডিয়াল বাংলা বইটি বের করে যুক্তাক্ষরহীন একটি বাক্য (গরুটি মাঠে চরছে) পড়তে বললাম। ওই ছাত্রী বাক্যটি পড়তে পারল না। কথা বলে জানতে পারলাম, তার মা লেখাপড়া জানেন না। বাবা কর্মসূত্রে বাইরে থাকেন। এই ছাত্রী প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া। খাতায়-কলমে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েও যার অক্ষরজ্ঞান হল না! বছর কয়েক পরে সে যে বাচ্চাটি জন্ম দেবে সে-ও প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া হয়েই বিদ্যালয়ে আসবে। এই ছাত্রী আসলে মাতৃভাষা পড়তে না পারা পড়ুয়ার হিমশৈলের চূড়ামাত্র। এমন হাজার হাজার পড়ুয়ার দেখা মিলবে স্কুলগুলোতে। কোনও বিদ্যালয়ের মোট পড়ুয়ার ২৫ শতাংশ, কোথাও ৩০ শতাংশ, কোথাও আবার ৬৫ শতাংশ পড়ুয়ার অক্ষরজ্ঞান নেই।
চলতি শিক্ষাবর্ষে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি শুরু হয়ে গিয়েছে। ফের কয়েকটি বিদ্যালয়ে এক অসম লড়াই শুরু হবে। ষাট থেকে পয়ষট্টি ভাগ পড়ুয়া মাতৃভাষা উচ্চারণ করে পড়তে পারে না। আশি থেকে পঁচাশি শতাংশ পড়ুয়া তৃতীয় শ্রেণির ইংরেজি বইয়ের দু’টি লাইন উচ্চারণ করে পড়তে পারে না। বিগত বছরগুলিতে এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে আমাদের। সারা বছরের পাঠক্রম বইয়ে লেখা থাকে। কিন্তু তা অনেক পড়ুয়ার ঠিকমতো নজরে আসে না। তাই পশ্চিমবঙ্গ সমগ্র শিক্ষা মিশন ঠিক করেছে পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণির সারা বছরের পাঠক্রম কবে, কী ভাবে শেষ হবে তা শ্রেণিকক্ষের বাইরে বড় বড় হরফে (পোস্টারের মতো টাঙিয়ে রাখতে হবে) লিখে রাখতে হবে। কিন্তু পোস্টার পড়ার জন্য যে বাংলা পড়াটা জরুরি, পশ্চিমবঙ্গ সমগ্র শিক্ষা অভিযানকে তা কে বোঝাবে?
আমরা জানি, পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হতে আসা পড়ুয়াদের প্রাক প্রাথমিক ও প্রাথমিকের বর্ণমালা, যুক্তাক্ষর, ইংরেজি, নামতা শেখানোর দায় ও দায়িত্ব উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নয়। তাঁদের দায়িত্ব পাঠক্রম অনুসারে সিলেবাস শেষ করা। কিন্তু যার অক্ষরজ্ঞান নেই, যে পড়তেই জানে না, তাকে কী ভাবে সিলেবাস অনুসারে পড়াবেন? দেশের শিক্ষার অধিকার আইন অনুসারে মাতৃভাষা পড়তে না পারা পড়ুয়াকেও পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি নিতে হবে। মাতৃভাষা পড়তে না পারা সত্ত্বেও সেই পড়ুয়াকে পাশ-ফেল না থাকার কারণে বছর বছর উপরের ক্লাসে উঠতে দিতে হবে। তাই মাতৃভাষা না জেনে কেউ ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। অষ্টম শ্রেণি শেষে নবম শ্রেণিতেও তারা ভর্তি হয়ে যায়। কিন্তু খাতায়-কলমে শিক্ষিত হলেও আদপে তাদের অক্ষরজ্ঞানই নেই! প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়ে আটটি বছর কাটানোর পরেও ওরা লিখতে-পড়তে পারে না। প্রতি দিন, প্রতি বছর এটা ঘটে চলেছে। এটা তো মানবসম্পদের চূড়ান্ত অপচয়। বক্তৃতা দেওয়ার সময় বলি, শিক্ষাই জাতীর মেরুদণ্ড। তবে এটা কোন শিক্ষা? এই শিক্ষায় পড়ুয়ার মেরুদণ্ড কোনও দিন কি সোজা হবে? এমন শিক্ষায় সমাজ তথা দেশের আদৌ কি উপকার হচ্ছে?
এই পড়ুয়াদের বেশিরভাগই প্রথম প্রজন্মের। প্রশ্ন হল, পড়ুয়াদের এই অবস্থার জন্য দায়ী কে? প্রথমত দায়ী ওদের বাবা ও মা। কারণ, তাঁরা সন্তানদের লেখাপড়ার যত্ন নেন না। বিদ্যালয়ে নিয়মিত পাঠান না। বাড়িতে কোনও দিন পড়তে বসেছে কি না তার খোঁজ রাখেন না। আদৌও উচ্চারণ করে পড়তে পারছে কি না তারও খেয়াল করেন না। কারণ, বাবা-মা কেউই লেখাপড়া জানেন না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এমনটাই হয়। দেখা যায়, বাবা রাজমিস্ত্রির কাজে, হরেক পণ্য বিক্রির কাজে বা অন্য কোনও কাজে বাড়ির বাইরে থাকেন। কেরল, তামিলনাড়ু, ওড়িশা, কলকাতায় তাঁরা জীবিকার খোঁজে বছরের বেশিরভাগ সময় কাটান। বাড়িতে লেখাপড়া না জানা মা সংসার চালানোর পাশাপাশি বিড়ি বেঁধে দু’পয়সা রোজগারের চেষ্টা করেন। তিনি ছেলেমেয়েকে স্কুলে ভর্তি করে ভাবেন, তারা লেখাপড়া শিখছে। কিন্তু ছেলেমেয়ে আদৌ বিদ্যালয়ে গেল কি না তার খোঁজ রাখেন না। তার পরেও তাঁরা কষ্টার্জিত টাকা খরচ করে ছেলেমেয়েদের টিউশন নিতে পাঠান। সেখানেও তাদের তেমন উন্নতি হয় না। এই পড়ুয়াদের একেবারে রিডিং শেখাতে গেলে যে ধরনের যত্ন নেওয়া দরকার তা সবক্ষেত্রে নেওয়া হয় না। বহু স্কুলের মতো এখন টিউশনেও ফাঁকি চলছে। সেখানেও পিছিয়ে পড়া পড়ুয়ারা অবহেলিতই থাকে।
দ্বিতীয়ত, দায়ী পাশ-ফেল প্রথা। পাশ-ফেল প্রথার কিছু ভাল দিক আছে বৈকি। কিন্তু ক্ষতির পরিমাণ সীমাহীন। ক্ষতিটা তাদেরই বেশি হয়েছে, যাদের কথা ভেবে পাশ-ফেল প্রথা তুলে দেওয়া হয়েছিল। সমাজের একেবারে নিম্নবিত্ত পরিবারের প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়ারা যেন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত (১৪ বছর বয়স) বিদ্যালয়ে পড়াশোনার পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রাখতে পারে। যাতে তার ব্যবহারিক জ্ঞান বাড়ে এবং জীবন বদলে যায়। কিন্তু ফল হল উল্টো। পাশ-ফেল না থাকার কারণে লেখাপড়া না জানা বাবা মায়েরা ভাবেন, ছেলেমেয়ে তো একটার পরে একটা ক্লাসে দিব্যি উঠে যাচ্ছে। ফেল তো করে না। সন্তানেরা কী শিখল আর কী শিখল না তা তাঁরা খেয়াল করেন না। কারণ, ছেলে-মেয়ে তো কোনও দিন এসে বলে না, ‘‘মা, আমি ফেল করেছি।’’ বিদ্যালয় থেকে ডেকে পাঠিয়েও কোনও দিন শিক্ষকেরা বলেননি, ‘‘আপনার ছেলেমেয়ে লেখাপড়া করে না, নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসে না বা পরীক্ষায় ফেল করেছে।’’ প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত কোনও বেতনও লাগে না। ফলে বাবা মায়ের অজান্তেই পড়ুয়ারা স্কুলে নিয়মিত না গিয়ে, পড়তে না শিখে চতুর্থ শ্রেণিতে উঠে যায়। প্রাথমিকের বহু শিক্ষকেরাও ওদের নিয়ে বেশি মাথা ঘামান না। মার্কশিটে নম্বর দিয়ে চতুর্থ শ্রেণির পাশের সার্টিফিকেট পড়ুয়াদের হাতে ধরিয়ে দিলেই তাঁদের দায়িত্ব শেষ বলে মনে করেন। (চলবে)

প্রধান শিক্ষক, লস্করপুর উচ্চ বিদ্যালয়

Education Academics Literacy
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy