Advertisement
E-Paper

আল্পস বর্জ্য বর্জিত, হিমালয়ে প্লাস্টিক খাচ্ছে গরু

প্লাস্টিক মুক্তির জন্য ভারত উদ্যোগী হয়েছে। তাতেও হিমালয় প্লাস্টিকে ভরা। কিন্তু সুইৎজারল্যান্ড উদ্যোগী হয়ে আল্পসের সৌন্দর্য নষ্ট হতে দেয়নি। অথচ প্লাস্টিক থেকে হতে পারে কর্মসংস্থানও।প্লাস্টিক মুক্তির জন্য ভারত উদ্যোগী হয়েছে। তাতেও হিমালয় প্লাস্টিকে ভরা। কিন্তু সুইৎজারল্যান্ড উদ্যোগী হয়ে আল্পসের সৌন্দর্য নষ্ট হতে দেয়নি। অথচ প্লাস্টিক থেকে হতে পারে কর্মসংস্থানও। আলোচনা করলেন শান্তনু ভৌমিক

শান্তনু ভৌমিক

শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০১৯ ০২:৫৪
মখমলের মতো তৃণভূমিতে গরু চড়ে বেড়াচ্ছে।

মখমলের মতো তৃণভূমিতে গরু চড়ে বেড়াচ্ছে।

সুইৎজারল্যান্ডের আল্পস পর্বতের একটি ছবির মতো গ্রাম। আন্ডারমাট। অসাধারণ সৌন্দর্য। বরফ ঢাকা পাহাড়। বহু পর্যটক এখানে আসেন। আল্পস থেকে নীচের দিকে তাকালে দেখা যায় মখমলের মতো তৃণভূমিতে প্রচুর গরু চড়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কোথাও কোনও প্লাস্টিক পড়ে নেই। সে দেশের প্রশাসন পুরো এলাকা একেবারে ঝকঝকে তকতকে করে রেখেছে।

বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ানোর কাজে সুইৎজারল্যান্ড যেতে হয়। সুযোগ পেলেই দেশটা ঘুরে দেখি। আর তখনই দেশের সঙ্গে তুলনা করতে ইচ্ছে করে। কারণ হিমালয়ে আমার যাতায়াত আছে। সেখানকার সৌন্দর্য নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। হিমালয়ের দেবভূমির কথাই ধরা যাক। পৌড়ি গঢ়বাল এলাকায় এখানে বহু আশ্রম রয়েছে। অসাধারণ সৌন্দর্য। আল্পসের সঙ্গে টক্কর দিতে পারে। ভক্তি এবং সৌন্দর্য, উভয়ের টানেই বহু মানুষ এখানে আসেন। সেই দেবভূমিতে কী দেখা যায়? দেখা যায় যে, প্লাস্টিকে ভরে গিয়েছে পৌড়ি গঢ়বাল। থরে থরে প্লাস্টিক। দেবভূমির সৌন্দর্যহানিতে ডাঁই হয়ে, ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা প্লাস্টিক যথেষ্ট কার্যকরী।

পরিবেশ দূষণের সঙ্গে এখানে আরও একটি খারাপ কাজ হয়ে চলেছে। হামেশাই দেখা যায়, গরুতে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা প্লাস্টিক খাচ্ছে। প্লাস্টিক মানুষ হোক বা প্রাণী, সবার ক্ষেত্রেই ক্ষতিকর। গরু প্লাস্টিক খেলে অবলা প্রাণিটির ক্ষতি। আবার প্লাস্টিক খাওয়া গরুর দুধ খেলে মানুষের ক্ষতি। হিমালয়ের বহু জায়গাতেই এই দৃশ্য দেখা যায়। উপরে অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্য। নীচে প্লাস্টিকের দূষণ।

কিন্তু এরকম তো হওয়ার কথা ছিল না। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করলেন স্বচ্ছ ভারত অভিযানের কথা। যার উদ্দেশ্য, ২০১৯ সালের মধ্যে ভারতকে একেবার স্বচ্ছ করে তোলা। প্লাস্টিক বর্জ্য মুক্ত ভারত গড়ে তোলা। ২০১৪ সালের ঘোষণায় বেশ জাঁকজমক ছিল। বলিউডের তারকা এবং ক্রীড়া জগতের নক্ষত্রেরা হাজির ছিলেন। লক্ষ্যমাত্রা ’১৯ সাল করার কারণ, এই বছর মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর ১৫০তম জন্মবার্ষিকী।

নতুন সরকার তৈরি করলেন নীতি আয়োগ। নীতি আয়োগ প্লাস্টিক বর্জ্য পুনর্নবীকরণের কাজ করবে। সহায়তায় এগিয়ে এল কেন্দ্রীয় বন এবং পরিবেশ মন্ত্রক। অত্যন্ত সৎ এবং সাধু উদ্যোগ। কিন্তু আমরা একই সঙ্গে গত চার বছরে দেখলাম, গোসম্পদ কী ভাবে রক্ষা করা যায় তার জন্য বহু লোকের চিন্তা শুরু হয়েছে। সেটা প্রায়ই আলোড়ন তোলে। গোরক্ষা নিয়ে শুরু হল রাজনীতি। হিংসাও ছড়াল। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল উল্টো চিত্র। হিমালয়ের প্লাস্টিক যে শুধু সেখানকার পরিবেশ এবং গরুর ক্ষতি করছে তা নয়। এই প্লাস্টিক আবার নদীতে পড়ছে। ফলে নদীও দূষিত হচ্ছে।

একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, সুইৎজারল্যান্ড কিন্তু ডেয়ারি শিল্পে যথেষ্ট উন্নত। এবার ভেবে দেখুন, সুইৎজারল্যান্ডের আল্পস প্লাস্টিক দূষণের কবলে। আর চড়ে বেড়ানো গরু সেই প্লাস্টিক পেটে পুরছে। সারা পৃথিবী জুড়ে কত মানুষ সেই দূষণের কবলে পড়তেন? হিসেবে আনা যাবে না। সুইৎজারল্যান্ড যদি তাদের পর্যটকদের জন্য প্লাস্টিক মুক্ত আল্পস তৈরি করতে পারেন আমরা পারব না কেন? সুইৎজারল্যান্ডে গোরক্ষার জন্য লাঠিসোঁটা নিয়ে বেরতে হয় না। রক্ষার কাজটা তারা যত্ন নিয়েই করেন। শুধু হিমালয় কেন সারা ভারতকেই প্লাস্টিক মুক্ত করা সম্ভব। ভারতে প্রতিদিন ১৬ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়। সেই বর্জ্য ক্যারিব্যাগ হতে পারে, জলের বোতল হতে পারে, ব্যাগ হতে পারে। এই ব্যাগ, জলের বোতল মানুষ ব্যবহার করছে সবথেকে বেশি পাঁচ মিনিট থেকে দু’ঘণ্টা। জল খেলাম। তার পর ফেলে দিলাম। বাজার থেকে কিছু এনে ঝুড়িতে ঢেলে বা ফ্রিজে রাখার পরে ব্যাগও বাতিল হয়ে গেল। ঘরের কাছে মেদিনীপুর শহর, খড়্গপুর, ঝাড়গ্রামের দিকে তাকান। প্লাস্টিকের সমস্যায় শহরের গলা বুজে আসছে দেখা যাবে।

কিন্তু এই সমস্যার সমাধান রয়েছে। আমাদের দেশের উপকূলের দৈর্ঘ্য সাত হাজার ৬০০ কিলোমিটার। গুজরাত থেকে শুরু হয়ে মহারাষ্ট্র, গোয়া, কেরল, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ, আন্দামান মিলিয়ে। এই বিশাল উপকূল অঞ্চলে অসংখ্য নারকেল এবং কলা গাছ রয়েছে। নারকেল এবং কলা থেকেও বর্জ্য হয়। নারকেল খাই। ছোবড়া ফেলে দিই। ছোবড়া ধুনো দেওয়ায় কিছু কাজে লাগে। আর কিছু কাজে লাগে লেপ, তোশক, পাপোশ তৈরিতে। বাকিটা বরজ্য। কলা খাই। খোসা রাস্তায় গড়াগড়ি দেয়। হিমালয় অঞ্চলে অসংখ্য প্রাকৃতিক তন্তু রয়েছে। প্লাস্টিক বর্জ্য আর প্রাকৃতিক তন্তু মিশিয়ে কিন্তু পুনর্নবীকরণ করা যায়। তা দিয়ে তৈরি হতে পারে নানা আসবাব। চেয়ার, টেবিল, দরজা, জানলা। এবং তৈরি করা যেতে নৌকা। এই আসবাবের গড় আয়ু হয়ে যাবে ২৫-৩০ বছর।

এতে সুবিধে কী হবে? সুবিধে হবে বহুমুখী। প্রথমত, যদি আসবাব তৈরি করা যায় তাহলে বহু গাছ বাঁচবে। ভারতের বিশাল উপকূল অঞ্চলে প্রচুর নৌকা চলে। শুধু সুন্দরবনেই ৮০ হাজার থেকে এক লক্ষ নৌকা চলে। একটা ছোট নৌকা তৈরি করতে দু’টো ছোট গাছ লাগে। কাঠের নৌকার আয়ু ৪-৫ বছর। কিন্তু প্লাস্টিক বর্জ্য আর প্রাকৃতিক তন্তু দিয়ে তৈরি নৌকার আয়ু ৩০ বছর। দ্বিতীয় সুবিধে হবে কর্মসংস্থানের। পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্লাস্টিক বর্জ্য ‘রিসাইক্লিং’য়ের মাধ্যমে আসবাব তৈরি হয় তাহলে এখানকার বাসিন্দারা কাজ পাবেন। ওড়িশায় হলে সেখানকার বেকারদের সুবিধা হবে।

নীতি আয়োগের কাছে এ বিষয়ে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখনও রূপায়ণের জন্য কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি। এ বিষয়ে আমরা কিছু কাজ করেছি। কয়েকজন গবেষক ছাত্র মিলে ছোট ছোট পণ্য বানিয়েছি। ছাত্র ছাত্রীদের কয়েকজন এই পণ্য নিয়ে ব্যবসা করতে উদ্যোগী। তাঁরা সকলে মিলে সংস্থা খুলতে চান। দেবেশ ভট্টাচার্য, অকল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছিলেন। তিনি দু’জন ছাত্রকে নিউজিল্যান্ডে নিয়ে গিয়ে প্রশিক্ষণ দিতে চান। ভারত উদ্যোগী হলে কিন্তু আখেরে লাভ। কর্মসংস্থান, পরিবেশ এবং স্বচ্ছ ভারত মিশনের সাফল্যের ক্ষেত্রেও।

লেখক এরোস্পেস বিজ্ঞানী

Alps Himalaya আল্পস Pollution
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy