Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
সত্যেরে লও সহজে!
Mamata Banerjee

বাংলার গুণিজনেরা এখন ‘মমতা’র স্পর্শ অনুভব করেন

এ কথা ঠিক যে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশিষ্টদের অধিকাংশের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা প্রথম থেকেই যোগাযোগ রক্ষা করে আসছেন। সেটা কিছুটা তাঁর স্বভাবজাত, কিছুটা প্রয়োজনভিত্তিক।

বিদায়: প্রয়াত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মরদেহে মালা দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৫ নভেম্বর, ২০২০। পিটিআই

বিদায়: প্রয়াত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মরদেহে মালা দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৫ নভেম্বর, ২০২০। পিটিআই

দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০২০ ০২:২৯
Share: Save:

রাজনীতিকরা যে সবাই সব সময় নিঃস্বার্থ ভাবে সব কাজ করেন, তা নয়। কিন্তু যেখানে যা করা সাধারণ বিবেচনায় শোভন ও সঙ্গত, সেখানেও আমাদের অনেকের নজর ‘মন্দ’ দেখে। যেমন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের শোকযাত্রা কেন্দ্র করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা। সমাজের কোনও কোনও মহল এতে খুশি নয়। তাঁদের ধারণা, মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে সারা ক্ষণ হাজির থেকে এই ভাবে সব তদারকি করা ‘বাড়াবাড়ি’! ভোট-রাজনীতিতে এর কী প্রভাব পড়তে পারে, সেই হিসাব কষছেন তাঁরা।

কথাগুলি প্রকাশ্যে বলতে হল। কারণ গত দু’তিন দিনে এমন কিছু আলোচনা কানে এসেছে। যাঁরা এই সব ভাবেন, তাঁদের রাজনৈতিক অভিপ্রায় নিয়ে কোনও কূট-বিশ্লেষণে যাব না। তবে এই সব অনভিপ্রেত ও দুর্ভাগ্যজনক চর্চার পরিপ্রেক্ষিতে অবশ্যই কিছু বলার থাকে। আগে কী হয়েছে এবং এখন কী হয়, তারও কিছু উল্লেখ এ ক্ষেত্রে দরকারি।

এ কথা ঠিক যে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশিষ্টদের অধিকাংশের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা প্রথম থেকেই যোগাযোগ রক্ষা করে আসছেন। সেটা কিছুটা তাঁর স্বভাবজাত, কিছুটা প্রয়োজনভিত্তিক। যাঁরা বঙ্গসমাজে নিজেদের কাজে ও কৃতিত্বে মাননীয়, যাঁরা সমাজের ‘মুখ’ বলে গণ্য হন, তাঁদের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সুসম্পর্ক রেখে চলার মধ্যে একটি সুস্পষ্ট বার্তা আছে। মুখ্যমন্ত্রী বিলক্ষণ তা বোঝেন।

কিন্তু ঘোষিত ভাবে মমতা-বিরোধী অবস্থান নিয়ে চলেন যাঁরা, তাঁদেরও অনেকের প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের খবর মুখ্যমন্ত্রী নিয়মিত রাখেন। দরকারে হাত বাড়াতে দ্বিধা করেন না। এটি হল মমতার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। কেউ এতে রাজনীতির উপাদান খুঁজে পেলেও এই সত্য বদলায় না।

সাম্প্রতিক উদাহরণ অগস্ট মাসের একটি ঘটনা। ছুটির দুপুরে হঠাৎ মুখ্যমন্ত্রী জানতে পারেন, এক জন বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী গুরুতর অসুস্থতা এবং অন্যান্য কারণে নিদারুণ কষ্টে রয়েছেন। দশ মিনিটের মধ্যে শিল্পীর স্বামীর কাছে সরকারের ফোন যায়। শিল্পীর চিকিৎসার খরচ ও মাসিক পেনশনের ব্যবস্থা হয়। ফাইলের বিলম্বিত প্রক্রিয়া এড়াতে নগদ অগ্রিমও পাঠানো হয়। সেই শিল্পী এখন প্রয়াত।

যে কোনও সরকারই নিজস্ব পছন্দের একটি বৃত্ত গড়ে নেয়। বৃত্তের বাইরে যাঁরা, তাঁরা অনেক সময় ‘ব্রাত্য’ হয়ে পড়েন। তবে এমন কিছু বিষয় থাকে, যেখানে কোনও রকম ভেদরেখার গোঁড়ামি ধৃষ্টতা। বামফ্রন্টের চৌত্রিশ বছরে তার কিছু প্রকাশ আমরা দেখেছি। মুক্তকণ্ঠে বলব, বাঙালির আবেগকে প্রাধান্য দিয়ে মমতা সেই বেড়া ভাঙার প্রমাণ দেন বার বার। সৌমিত্রবাবু তার এক স্মরণীয় দৃষ্টান্ত। সে আলোচনা পরে।

আগে ফিরে দেখা। প্রথমে উত্তমকুমার ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কথা ধরা যাক। উত্তমবাবুর মৃত্যু হয় ১৯৮০ সালে। হেমন্তবাবুর প্রয়াণ ১৯৮৯-তে। সেই সব সময়ে মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন জ্যোতি বসু। তাঁর মন্ত্রিসভায় সংস্কৃতির দায়িত্বে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।

বাঙালি এটা নিশ্চয় মানেন যে, পর্দার নায়ক উত্তমকুমারের জনপ্রিয়তা রাজনীতির নায়ক জ্যোতিবাবু বা প্রমোদ দাশগুপ্তের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল ছিল না! হেমন্তবাবুও নিজের জোরেই বাঙালির হৃদয়-মণি। তবে দু’জনের কেউ ক্ষমতাসীন বামেদের ‘কাছের লোক’ বলে চিহ্নিত ছিলেন না। তাঁদের প্রয়াণে কী ছিল সরকারের ভূমিকা?

সদ্য সাংবাদিকতায় এসে উত্তমকুমারের শোকযাত্রা দেখেছিলাম। মানুষ কতটা উদ্বেল হয়ে উঠতে পারে, তার বিশদ বর্ণনা এখানে বাহুল্য। এটুকু বলি, মিছিলের যাত্রাপথে এবং শ্মশানে যত ভিড় হয়েছিল, তাতে চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা ছিল পুরোমাত্রায়। রবীন্দ্র সদনের চাতালে উত্তমবাবুর দেহ রাখার বাস্তব পরিস্থিতি সে দিন ছিল না। তবে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবাবু বা তাঁর কোনও সতীর্থ স্বহস্তে মালা দিয়েছিলেন বলে মনে পড়ে না।

হেমন্তবাবুকে অল্প সময় রবীন্দ্র সদনে আনা হয়েছিল। ভিড়ের চাপে রাখা যায়নি। জ্যোতিবাবু নিজেই সেখানে মালা দিতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন। উত্তম ও হেমন্তের জন্য গান স্যালুট ছিল না। ছিল সাধারণ মানুষের শোকোচ্ছ্বাস।

প্রশ্ন হতে পারে, সরকার এই সম্মান দেবে কেন? উত্তর— সরকার এ ক্ষেত্রে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অনুভূতিকে মূল্য দেবে। যাঁদের জোরে সরকার ক্ষমতায় বসে, সেই জনতার আবেগ সরকারকে স্পর্শ করবে, এটাই সঙ্গত। জ্যোতিবাবুরা হয়তো ওই দু’জনের বেলায় সে সব বিবেচনা করেননি।

তবে সত্যজিৎ রায়ের ক্ষেত্রে তা করা হয়েছিল। যথার্থ ভাবেই অন্ত্যেষ্টি চলাকালীন শ্মশানে উপস্থিত ছিলেন বুদ্ধদেববাবু, সিপিএম-এর প্রয়াত রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাস-সহ শাসক নেতা-মন্ত্রীরা।

আর ঘটনাচক্রে সেখানে সবার সামনে ঘটে যায় কেওড়াতলার আলোড়নকারী ‘শ্মশান-স্বপন’ কেলেঙ্কারি! একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু পরিবেশ নিমেষে কদর্য চেহারা নেয়। চার পাশ অন্ধকার হয়ে যায়। উড়ন্ত ইট, সোডার বোতলের মুখে আতঙ্কে কাঁপতে থাকেন বিশিষ্ট জনেরা। শ্মশান থেকে বেরিয়ে দেখি, রাস্তায় ভাঙা কাচের কার্পেট! সত্যজিতের অন্ত্যেষ্টি ছাপিয়ে সমাজবিরোধী দৌরাত্ম্য দেখতে হয়েছিল সে দিন! তার পর যে আরও কত ক্লেদ সামনে এসেছিল, অনেকেরই তা মনে আছে।

সুচিত্রা সেন চাননি, মৃত্যুর পরেও তাঁর মুখ প্রকাশ্যে আনা হোক। হাসপাতাল থেকে বড় ঘোমটায় ঢেকে তাঁর দেহ প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় বাড়িতে। শ্মশানে ভিড় উপচে পড়েছিল। পুলিশকে সরিয়ে মমতা জোড়হাতে সেই ভিড়কে সংযত করছিলেন। কেউ তাঁকে বাধ্য করেনি তা করতে।

বাঙালির আর এক গর্বের সম্পদ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি কী মাপের অভিনেতা, তাঁর শিল্পীসত্তা, মননশীলতা কত বিচিত্রগামী ইত্যাদি নিয়ে আমজনতার কোনও মাথাব্যথা নেই। তাঁরা সৌমিত্রকে চেনেন নিজেদের শর্তে। ভালবাসেন নিজেদের পছন্দে। তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে ছুটেছিলেন তাঁরাই। মুখ্যমন্ত্রী মমতা সাধারণ মানুষের সেই ‘চাওয়া’কে অস্বীকার করার উন্নাসিকতা দেখাননি। তাই সৌমিত্রবাবু ঘোষিত বামপন্থী হওয়া সত্ত্বেও বরাবর তাঁর সঙ্গে তিনি সংযোগ রেখে চলতে চেয়েছেন। সৌমিত্রবাবুর দিক থেকে শীতলতা তৈরি হয়েছে একাধিক বার। নন্দনের ঘেরাটোপ থেকে চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধন-পর্ব নেতাজি ইনডোরে আনার পরে তাকে ‘সার্কাস’ বলে এক বার তো উৎসবই বয়কট করেছিলেন তিনি। মমতার ইচ্ছায় তাঁকে রাজি করিয়ে শেষ দিনে আনা হয়েছিল। অন্য একটি ঘটনায় সরকারি পুরস্কার নিতে নিজে আসেননি সৌমিত্রবাবু। গত লোকসভা নির্বাচনেও তিনি প্রকাশ্যে বামেদের সমর্থনে কথা বলেছেন।

কিন্তু এ সব কোনও কিছুই বাধার কারণ হয়নি। কারণ তিনি সৌমিত্র। বছর দুই আগে তাঁর নাতি দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হওয়ার পরে মমতা নিজে থেকে যে ভাবে এগিয়ে গিয়েছিলেন, সৌমিত্রবাবুকে তা-ও ‘স্পর্শ’ করেছিল। তিনি বলতেন সে-কথা।

এ বার স্বয়ং সৌমিত্রবাবু হাসপাতালে ভর্তির পর তো কথাই নেই। সরকার তাঁর চিকিৎসার ভার নেওয়ার পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রী ব্যক্তিগত ভাবে নিয়মিত কথা বলতেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। যোগাযোগ রাখতেন শিল্পীর পরিবারের সঙ্গেও।

রবীন্দ্র সদন থেকে সৌমিত্রবাবুর শোকমিছিলে পা-মিলিয়ে এবং শেষ পর্যন্ত থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা যদি কোনও বার্তা দিয়েই থাকেন, তবে তা নিছক ভোট কুড়োনোর জন্য নয়। বাঙালির নস্ট্যালজিয়া, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধায়। কারণ এটা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রাপ্য এবং রাজ্যবাসীর কর্তব্য। মুখ্যমন্ত্রী তারই প্রতিনিধিত্ব করেছেন।

এই প্রয়াসকে কোনও ভাবে খাটো করার অর্থ সৌমিত্রবাবুর অপমান। বাঙালি মানবে তো?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE