Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

অসহনীয়

পুরুষতন্ত্র মনে করে, নারীমাত্রই হয় ক্রয়যোগ্য, নয় জয়যোগ্য। যুদ্ধ বাধাইবার মধ্যে তাহা ‘পৌরুষ’ দেখিতে পায়, কারণ তাহাতে নারীশরীর একই সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্র এবং যুদ্ধের পারিতোষিক হইয়া ওঠে। এ সত্য ভারতে কে ভুলিতে পারে? ইতিহাসের পাঠ্য হইতে সংবাদপত্রের পাতা, সর্বত্রই তাহার অপর্যাপ্ত প্রমাণ।

কুর্নিশ। ডেনিস মুকওয়েগে এবং নাদিয়া মুরাদ। ছবি: সংগৃহীত।

কুর্নিশ। ডেনিস মুকওয়েগে এবং নাদিয়া মুরাদ। ছবি: সংগৃহীত।

শেষ আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০১৮ ০০:৪৮
Share: Save:

পুরুষতন্ত্র মনে করে, নারীমাত্রই হয় ক্রয়যোগ্য, নয় জয়যোগ্য। যুদ্ধ বাধাইবার মধ্যে তাহা ‘পৌরুষ’ দেখিতে পায়, কারণ তাহাতে নারীশরীর একই সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্র এবং যুদ্ধের পারিতোষিক হইয়া ওঠে। এ সত্য ভারতে কে ভুলিতে পারে? ইতিহাসের পাঠ্য হইতে সংবাদপত্রের পাতা, সর্বত্রই তাহার অপর্যাপ্ত প্রমাণ। এই বৎসরের নোবেল শান্তি পুরস্কার সেই বেদনাময় সত্যকে পুনরায় মনে করাইল। নোবেল কমিটি সম্মানিত করিল এমন দুই ব্যক্তিকে, যাঁহারা মহিলাদের উপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে নিয়ত সরব, সক্রিয়। ইরাকের ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের কন্যা নাদিয়া মুরাদ যৌন দাসত্ব ও লাগাতার গণধর্ষণের ভুক্তভোগী। ইসলামিক স্টেট তাঁহার উপর অবর্ণনীয় অত্যাচার করিয়াছে। তাঁহার মতো অন্তত তিন হাজার ইয়াজিদি মহিলা, তথা যে কোনও সংঘাতের পরিণামে নির্যাতিতা মেয়েদের মুখপাত্র হইয়া উঠিয়াছেন এই তরুণী। চিকিৎসক ডেনিস মুকয়োয়েগে কঙ্গোতে গৃহযুদ্ধের পরিণামে নির্যাতিত মেয়েদের উপর অস্ত্রোপচার করিতেছেন দীর্ঘ দিন। তিনি ধর্ষণকে যুদ্ধাস্ত্র হিসাবে ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রচার করিতেছেন। রাষ্ট্রপুঞ্জে তাঁহার বক্তৃতায় বলিয়াছেন, পারমাণবিক বা রাসায়নিক অস্ত্র যুদ্ধে ব্যবহার যেমন নিষিদ্ধ হইয়াছে, তেমনই যুদ্ধাস্ত্র হিসাবে ধর্ষণের ব্যবহার নিষিদ্ধ হউক। কাজটি কঠিন। সংঘাতের পরিস্থিতিতে নিরপরাধ মহিলাদের উপর পরিকল্পিত যৌন হিংসা বিশ্বের প্রায় সকল দেশে ঘটিয়া চলিয়াছে। মেয়েদের শরীরের অসম্মান, তাহাদের যোনি ও গর্ভ ‘দখল’ হইল সাঙ্কেতিক বিজয়চিহ্ন। বিপক্ষকে শায়েস্তা করিবার সহজতর উপায় আর কী আছে?

এই পুরস্কার ভারত তথা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিকে গভীর আত্মবীক্ষণে বাধ্য করিবে। দেশভাগের দাঙ্গায় বাংলার ও পঞ্জাবের মেয়েদের উপর যে অত্যাচার হইয়াছিল, দেশের স্মৃতিতে তাহার ক্ষত মুছিবার নহে। তাহার পরেও প্রায় প্রতিটি দশকে ভারতের কোনও না কোনও প্রদেশে দাঙ্গা-সংঘাত ঘটিয়াছে, নারীশরীর দুই পক্ষের সংঘাতভূমি হইয়া উঠিয়াছে। একবিংশ শতাব্দীতে আসিয়াও মুক্তি মেলে নাই মেয়েদের। ২০০২ সালে গুজরাতের দাঙ্গায় তিনশতেরও অধিক মুসলিম মহিলা ধর্ষিত, নিগৃহীত হইয়াছিলেন। ২০১৩ সালে উত্তরপ্রদেশের মুজফ্ফরনগরের দাঙ্গায় অন্তত একশত মহিলার উপর চরম নির্যাতন হয়। তাঁহাদের ন্যায়বিচার মেলে নাই। মুজফ্ফরনগরের ঘটনায় মাত্র সাত জন মহিলা ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করিয়াছিলেন। ভীতিপ্রদর্শনের ফলে ছয় জনই পরে নাম প্রত্যাহার করিয়াছেন। এক জনেরও শাস্তি হয় নাই।

মহিলাদের উপর হিংসার প্রতি রাষ্ট্র এবং সমাজের এই সহনশীলতাকেই আক্রমণ করিল এ বারের শান্তি নোবেল। পুরুষতন্ত্র শিখাইয়াছে, নির্যাতনের প্রতিবাদ মেয়েদেরই লজ্জা। পুরুষের অসম্মান করিবার শাস্তি মেয়েটিকে বহন করিতে হইবে, তাই নীরব থাকাই শ্রেয়। পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্র সরব মেয়েদের নীরব করাইতে তৎপর। গত বৎসর হইতে ‘আমিও’ (মি টু) আন্দোলনটি সেই নীরবতার প্রাচীর ভাঙিয়াছে। কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা হইতে যুদ্ধক্ষেত্রে গণধর্ষণ, মেয়েদের বিরুদ্ধে শারীরিক ও মানসিক অপরাধের তীব্রতা যেমনই হউক তাহা অপরাধ। অতএব সেই অপরাধের শাস্তি পাইবার কথা। তাহা সহিবার কথা নহে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Nobel Nobel Peace 2018 Editorial Women
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE