Advertisement
E-Paper

আমার ভিটের উঠোনে থম মেরে আছে সময়

ঠাকুমার কাছে গপ্পো শোনা সেই সবুজ-শরতে ঢাকা শেকড়ের খোঁজে পাড়ি দিয়েছিলেন দেশের ভিটেতে, তারই আঁচ বুনছেন দেবর্ষি ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০১৯ ০৩:৩৪
খুলনায় বিসর্জনের ছবি।

খুলনায় বিসর্জনের ছবি।

ভিটের সামনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে সময়। মুছে গেছে দেশ ভাগ, ভেঙে চুরমার গেছে বিভাজনের বেড়াজাল। আজ এই শারদময় পুলকিত দিনে আমার মুখোমুখি আজন্মকাল স্বপনে লালিত আমাদের ‘দেশের বাড়ি’। দেখে চমকে গেলাম, বাড়ির ‘দক্ষিণের পুকুরে’ ‘রোদেলা দুপুরে মধ্য পুকুরে’ আমার নব্য যুবক বাবার ‘অবাধ সাঁতার’। উঠোনে কাঠের পিড়িতে উবু হয়ে ঘোমটা মাথায় বসে বোধনের আয়োজনে ব্যস্ত ঠাকুমা। পিসিরা আজানু কেশ এলিয়ে শারদ রোদ্দুরে যৌবনের আঁচে তা দিয়ে নিচ্ছে। কৈশোর পেরিয়ে যৌবনের দরজায় অপেক্ষমাণ কাকারা কেউ আমগাছের সওয়ারি, কেউ বা গলা জলে ডুবে পদ্মের খোঁজে। আশ্বিনের মধ্যাহ্নের আলস্যের আস্কারায় আরামকেদারায় গা এলিয়ে বোধনের অপেক্ষায় রাশভারী দাদুভাইয়ের দু’দণ্ড অবসর। পালমশাই পুরু কাঁচের ভেতর থেকে ধোয়ামোছা ঠাকুর দালানের বেদির ওপর অধিষ্ঠিতা একচালার দেবীর সদ্য আঁকা ত্রিনয়নের পানে ফিরে ফিরে দেখে নিশ্চিন্ত হচ্ছেন। নিকানো উঠোনে পুজোর আয়োজনের সাজসাজ রব। ঘরদোরময় পুজোর গন্ধ। ধানের গোলার চারপাশে চড়ুইয়ের সংসার। রান্নাঘরে ক্লান্ত উনুনের জিরিয়ে নেওয়ার ক্ষণিক অবকাশ। সংসার যেন ভরপুর সাহচর্যের সহমর্মিতায় ভরা।

হঠাৎ কে যেন খবর খুঁড়ে আনল। দেশ নাকি ভাগ হবে! স্বদেশ নাকি বিদেশ হয়ে যাবে! ছেড়ে যেতে হবে ভিটেমাটি, আম-জাম-কাঁঠাল ঘেরা স্বপ্নের শান্তিনীড়। শারদ মধ্যাহ্নের আলস্য ভরা পুকুরের আলসেমি ভেঙে রুই-কাতলার উল্লাসের কলরোল। দালানের কোণে অনাদরে বেড়ে ওঠা বাতাবিলেবু গাছের কোঠরে দোয়েলের স্বপ্ননীড়। সব ভেঙে খানখান হয়ে যাবে! এত মানুষের জন্মভূমি, এত মানুষের বাস্তুভিটে, এত মানুষের দামাল ছেলেবেলা, উদ্দাম কৈশোর, মন কেমন করা যৌবন, স্মৃতির জাবর কাটা বার্ধক্য, এত মানুষের ‘দেশ’, এত মানুষের আবেগ …সব স্মৃতিতে আগলে নিয়ে চলে যেতে হবে! জাতিদাঙ্গার আগুনের লেলিহান শিখার লকলকে জিহ্বা দাবানলের গতিতে ছড়িয়ে পড়েছে ততক্ষণে। প্রাণের বিনিময়ে সব ছেড়ে চলে যেতেই হবে। তবু ‘যেতে নাহি দিব’।

গোলা ভরা ধানের টসটসে গাল বেয়ে গলে পড়া নোনতা জল, আম-কাঁঠাল বৃক্ষবনের গা বেয়ে বয়ে যাওয়া উতলা বাতাসের করুণ কাকুতি, রোদেলা পদ্মপুকুরের ছলছল চাহনি, ভিটেমাটির মায়া ভরা নিদারুণ আকুতি। সব ফেলে স্মৃতিকে আঁচলে বেঁধে চলে যেতে হবে অন্য এক দেশে, ছেঁড়া ছেঁড়া দুঃসহ দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে অজানা কোন ‘নিরাপদ’ আশ্রয়ের দিশাহীন সন্ধানে। ততক্ষণে ঠাকুর দালানের বেদী থেকে হেলে পড়েছেন দেবী দুর্গা। লক্ষকোটি ভিটেমাটি ছাড়া মানুষের বুকফাটা হাহাকার আর তীব্র ক্রন্দনরোলের ঝাপটায় ভিজে গিয়েছে ঠাকুর দালানের ধোয়ামোছা বেদি। কেঁপে উঠেছে দেবীর ত্রিনয়ন। খসে পড়েছে তাঁর সাজসজ্জা। কে বাজাবে বোধনের ঢাক! কে বা দেবে দেবীর পূজো! কেই বা বাজাবে সন্ধি পূজোর শাঁখ! সারা গাঁ উজাড় করে পথে ঢল নেমেছে উদ্বিগ্ন, সন্ত্রস্ত, অসহায় উদ্বাস্তুদের সর্বহারার মিছিল! কেবল জল থইথই ঠাকুর দালানের মাঝে একাকিনী পড়ে থাকে নিঃস্ব, রিক্ত, অসহায় দশভুজার নিথর দৃষ্টি।

বাবা যেদিন আবার রাতগভীরে এসে আমার চুলে বিলি কাটতে কাটতে শুনতে চাইবেন তাঁর ফেলে আসা জন্মভূমির কথা, তাঁর দামাল ছেলেবেলার চারণভূমির কথা, তাঁর কৈশোরের বহমান নদীর উচ্ছলতার কথা, হেসে গলে গিয়ে বাবাকে বলব, “বাবা, তোমরা কিন্তু অজ গাঁয়ে থাকতে”। দ্বিজাতি তত্ত্বে দেশভাগ দেশের এক বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে যে ভয়ঙ্কর অস্তিত্বের সংকটে ফেলেছিল, তা আজ এত দিনে আশ্বিনের কুয়াশার আবছায়ায় অস্পষ্ট হয়ে গেলেও, ফেলে আসা ওই অসংখ্য বাস্তুভিটের কম্পিত হৃদয়, ওই সারি সারি বৃক্ষবনের করুণ মর্মরধ্বনি, ওই অজস্র নদী বাঁকের ব্যকুল উচ্ছলতা, স্মৃতিকাতরতার মন্ত্রমুগ্ধতায় আজও বুঝি আচ্ছন্ন হয়ে আছে। ঢলে পড়া সূর্যের কোলে ধলেশ্বরীর নির্বিকার ছলাৎ ছলাৎ, ক্ষীণকায়া ধানসিঁড়ির উদাসীন বহমানতা, সুগন্ধার বক্ষ জুড়ে বয়ে চলা জাহাজের মর্মভেদী সাইরেন, পদ্মার কালো জলের কোঠরে শাপলা ফুলের খিলখিল হাসি, যেন দেশ-দেশান্তরের আন্তর্জাতিক সীমারেখাকে বিদ্রূপ করে অনন্ত মুক্তির প্রতীক্ষায় আজও অপেক্ষমাণ। শিকড়ের খোঁজে এসে জীবনের সব পাতাগুলো ভিজিয়ে নিয়েছি অবিরাম বারিধারার আকণ্ঠ আলিঙ্গনে। প্রাণপণে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছি, সেই সোনালি সোনালি চিল, শিশির করে নিয়ে গেছে যারে। যেন ভেসে গিয়েছিলাম কালিদাসের ‘মেঘদূত’-এর ডানায় চেপে। যেখানে আর কোনও দিন ফিরে যাওয়া যায় না, কিন্তু তার ঘ্রাণ এসে আবেগাপ্লুত করে দেয় আমাদের জীবন, আমাদের ইহকাল, পরকাল। জীবনের অমোঘ সত্য মেনে নিয়ে আমিও ফিরে এসেছি আমার ‘নিজভূমে’। মন কেমন করা ‘দেশের বাড়ির’ একাকীত্বকে অনেক পিছনে ফেলে। ‘দেশের বাড়ির’ দুর্গা প্রতিমার বিসর্জন ততদিনে হয়ে গেছে সারা। ‘শুধু মনের মধ্যে জেগে আছে ওই নয়নের তারা’। ‘ভিনদেশী’ বন্ধুবর মীর জিয়াউদ্দিন মিজান, যার কথা না বললে ভবিষ্যতের কাছে অপরাধী হয়ে থেকে যেতে হবে। জাতি, ধর্ম, আন্তর্জাতিক বেড়াজালকে অতিক্রম করে এই মহানুভব বন্ধুটি এবং তাঁর পরিবারের আতিথেয়তা কখনোই বুঝতে দেয়নি যে আমরা বস্তুত ভিনদেশে এসে পড়েছি। প্রতিটি মুহূর্তে মিজান ভাই যেন আমারই রক্ত সম্পর্কিত অগ্রজের ভূমিকায় অবতীর্ণ। ঠিক যেন কীর্তনখোলা আর আড়িয়াল খাঁর জলধারা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল কূলহীনা মেঘনার অথৈ পারাবারে।
(সঙ্গের ছবিটি খুলনায় বিসর্জনের)

লেখক : শিক্ষক, এসআর ফতেপুরিয়া কলেজ, বেলডাঙা

durga puja nostalgia partition
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy