Advertisement
E-Paper

পাল্টা প্রচারের হাতিয়ার

জয়ন্ত ঘোষাল

শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ২৩:০০
অসন্তোষ: মূল্যবৃদ্ধি ও দুর্নীতির প্রতিবাদে বিজেপি-বিরোধী বন্‌ধের দিন কংগ্রেস কর্মীদের মিছিল, শিলিগুড়ি, ১০ সেপ্টেম্বর। ছবি: এএফপি।

অসন্তোষ: মূল্যবৃদ্ধি ও দুর্নীতির প্রতিবাদে বিজেপি-বিরোধী বন্‌ধের দিন কংগ্রেস কর্মীদের মিছিল, শিলিগুড়ি, ১০ সেপ্টেম্বর। ছবি: এএফপি।

শুনেছেন তো বিকাশদাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বিকাশদা নিরুদ্দিষ্ট।— রোববার আমাদের আড্ডাটা এ ভাবেই শুরু হয়েছিল। দিল্লির বাঙালি পাড়া চিত্তরঞ্জন পার্ক। সেখানে নকুলের চায়ের দোকানে আমাদের কথা হচ্ছিল। প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল নিখোঁজ বিকাশদা। শম্ভুদা বলল বিকাশ মানে উন্নয়ন। গত পাঁচ বছর ধরে তো শুনে এলাম, বিকাশদা আসবে। বিকাশ আসছে। অচ্ছে দিন মানেই তো দেশের উন্নয়ন। বুলেট ট্রেন চলবে। রাস্তাঘাট ব্রিজ সব সিঙ্গাপুরের মতো হবে। আদা দেওয়া গরম চায়ে চুমুক দিয়ে আমাদের সজনীদা বললেন, দুস। অনেক আশা করেছিলাম এই মোদী সরকারের কাছ থেকে। খালি বড় বড় কথা। বাপু, গত পাঁচ বছরে জিনিসপত্রের দাম তো আগুন। তেলের দামের অবস্থা বাড়তে বাড়তে রেকর্ড।

নকুলের এই চায়ের দোকানটিতে খুব হাইফাই মানুষ আসেন, এমন নয়। পাড়ার প্লাম্বার থেকে সিকিয়োরিটি স্টাফ, স্থানীয় ছোট ছোট দোকানদার, মিস্ত্রি, এমনকি বাড়ির ‘কাজের লোক’রাও আসেন। আবার পাড়ার অবসরপ্রাপ্ত আমলারাও হাঁটতে হাঁটতে এখানে এসে হাজির হন। এই মানুষজন যাঁদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, এঁরা বিদ্বৎসমাজ নয়। বামপন্থী বুদ্ধিজীবী নন। রাজনৈতিক দলের অ্যাক্টিভিস্ট নন। এঁরা অনেকেই ২০১৪ সালে মোদীকে ভোট দেন এই ভেবে, এ বার বোধ হয় তাঁদের দারিদ্র ঘুচল। মানুষ ভাবতে শুরু করেছিেলন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেশে জেমস বন্ড এসে গিয়েছেন। অথবা সুপারম্যান–ব্যাটম্যান। অচ্ছে দিনের অলৌকিক কাণ্ড ঘটবে এ বার। যুবকেরা চাকরি পাবে। জিনিসের দাম কমে যাবে। প্রত্যাশা ছিল গগনচুম্বী। এমনটাই হয়। বামফ্রন্টকে সরিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হলে পুরুলিয়ার এক গ্রামবাসী মা আমাকে বলেছিলেন, দিদি এসে গিয়েছেন। কত বছর হয়ে গেল আমার মেয়েটার বিয়ে হচ্ছে না। আমরা গরিব তো। এ বার নিশ্চয়ই আমার মেয়েটার বিয়ে হয়ে যাবে। সত্যিই কি বিশ্বাসে মিলায় বস্তু?

নকুলের চায়ের দোকান থেকে হাঁটতে হাঁটতে এলাম চিত্তরঞ্জন ভবনের কফি লাউঞ্জে। এখানেও উত্তপ্ত আলোচনা। বেশ বোঝা যাচ্ছে, ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের নির্ঘণ্ট ঘোষণা না হলেও দেশের মানুষ কিন্তু ভোট নিয়ে ইতিমধ্যেই উত্তেজিত। যেখানেই যাচ্ছি, বুঝতে পারছি মানুষ ক্ষুব্ধ, অসন্তুষ্ট। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। চাকরি নেই। কী হল, বিদেশ থেকে কালো টাকা ফেরত এল কই? উল্টে নীরব মোদী পালাল। বিজয় মাল্যকে ফেরানো গেল না। টাকার দাম মুখ থুবড়ে পড়ল। তবে দিল্লির বাঙালিদের একটা বড় অংশ আজও মোদীভক্ত। এত কিছুর পর আজও বিজেপির জনপ্রিয়তম মুখ মোদীই। ভোট এ বারও হবে মোদী ফ্যাক্টরের উপরেই। সিদ্ধার্থদা বললেন, ১৯৪৭ সাল থেকে মূল্যবৃদ্ধি আর মুদ্রাস্ফীতির সমস্যায় এই মহাভারত আক্রান্ত। হক কথা— তাল ঠুকে বললেন অপরাজিতদা। আমি বললাম, মানছি। নেহরু মুখ্যমন্ত্রীদের চিঠি দিয়ে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু এটাও তো মানতে হবে যে, মূল্যবৃদ্ধি সর্বদাই বিরোধীদের প্রচারের বড় হাতিয়ার। শাসক দলকে এ বিষয়ে রক্ষণাত্মক হতেই হয়। বিজেপি যখন বিরোধী দল ছিল, তখন মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে তারা কী করেছিল মনে নেই?

দিল্লি কেন, গোটা দেশের সব চেয়ে দামি অভিজাত বাজার খান মার্কেট। সে দিন পড়লাম, এই বাজারের প্রতি স্কোয়ার ফুট পিছু বাজারদর সর্বোচ্চ। খান মার্কেটের এক রেস্তরাঁয় রাহুল এসেছিলেন মধ্যাহ্নভোজন করতে, গোটা বাজারে সে দিন আলাপ-আলোচনা। দেখলাম সকলেই মানছেন, ক’দিন আগেকার রাহুল আর আজকের রাহুল এক নন। এখন বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বও রাহুলকে সিরিয়াসলি নিচ্ছেন। ক্রমশ রাহুলই সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠছেন।

খান মার্কেটের বড় দোকান মার্কারি। দোকানের মালিক ভদ্রলোক দিল্লির বহু বৈশ্য-সম্প্রদায়ের মানুষের মতোই মোদীর জন্যই বিজেপিকে ভোট দেন। কিন্তু জিএসটি আর বিমুদ্রাকরণের পর তো বাজারে এত খারাপ প্রতিক্রিয়া হয় যে, তিনি ঘোরতর বিজেপি-বিরোধী হয়ে উঠেছেন। মোবাইল মিউজ়িক-সিস্টেমের দোকানে মুকেশের পুরনো হিন্দি গান চলছিল। মালিক বললেন, বাজারের কোমর ভেঙে গিয়েছে। এখন কথা, বিকল্প কী হবে? আবার খিচুড়ি সরকার? সেও তো বিপদ। ভারতে অনেক বার খিচুড়ি জোট দেখেছি। কিন্তু সে সব জোট তো স্থায়ী হয় না। অথচ এখন মনে হচ্ছে, যা ইচ্ছে হোক, যে ইচ্ছে আসুক, এই সরকারটার যাওয়া দরকার।

এ অবস্থায় বিজেপি কী করছে? আমরা সবাই বুঝতে পারছি, গোটা দেশে মোদী সরকার-বিরোধী অসন্তোষ তীব্র, আর নরেন্দ্র মোদী বুঝতে পারছেন না, এ-ও কি হয়? বাইরে এই অবস্থা, আর তিনি ধোকলা খেয়ে দিবানিদ্রায় মগ্ন, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। পাল্টা রণকৌশল নিশ্চয়ই তৈরি হচ্ছে, যা হয়তো আমরা এখনও জানতে পারছি না। কী হতে পারে সেটা? ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সম্ভাবনা? রামমন্দির নির্মাণ? এ সব বিষয় ভোটে বড় প্রভাব ফেলবে, এমনটা এখনও বোধ হয় না।

উত্তরপ্রদেশের বহু সাংবাদিকের ধারণা, বিজেপির আপাতত রণকৌশল একটাই। প্রাত্যহিক সাম্প্রদায়িকতা। বড় কোনও দাঙ্গা নয়। মুসলিম এলাকাতেও অতিসক্রিয়তা নয়। গোটা দেশ জুড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সংখ্যালঘু-বিরোধী প্রচার চালানো। পাকিস্তান আর হিন্দুবিরোধীদের ‘সবক’ শেখাতেই হবে। এটা পারে একমাত্র বিজেপি। অন্য দলগুলি তো ওদের মাথায় তুলে রেখেছে। ২০০২ সালে উত্তরপ্রদেশে এই কৌশল সাফল্য অর্জন করে যা ২০১৪ সালেও একই ভাবে বিজেপিকে লাভের পসরা দিয়েছে। ২০০৫ সালে মাউ, ২০০৭ সালে গোরক্ষপুর, ২০১৩ সালে মুজফ্ফরনগরে যা করা হয়েছিল, সেটাই করা হবে ২০১৯-এও।

সে দিন বাড়িতে রক্তপরীক্ষার জন্য এসেছিল বরেলীর ছেলে চতুরানন নেগি। বলছিল, ‘‘জানেন সে দিন পুরনো দিল্লিতে মুসলিম পাড়ায় গিয়েছিলাম রক্ত নিতে। আমার খুব ভয় করছিল, যদি ওরা আক্রমণ করে।’’ আমি প্রতিবাদ জানিয়ে বললাম, কেন এমন ভাবছ? ওঁরাও তো সহজ স্বাভাবিক মানুষ, সমস্যা তোমার মনে! সে বলল, ‘‘না স্যর, একমাত্র বিজেপিই পারে ওদের টাইটে রাখতে। অন্য সব দল ভোটের জন্য ওদের জামাই করে রাখে।’’ বুঝলাম এটাই প্রাত্যহিক সাম্প্রদায়িকতা!

দেখতে গিয়েছিলাম সাম্প্রতিক ছবি ‘মুল্‌ক’। দেশভাগের পর ভারতে থেকে যাওয়া বেনারসের মুসলিম পরিবার, তার কর্তা স্বয়ং ঋষি কপূর। ছবির শেষ পর্যন্ত, তিনি ভারতীয় জাতীয়তাবাদী। দেখলাম, রাজধানীর দর্শক একদম চুপচাপ। হাততালি পড়ছে না। অথচ পাকিস্তান আর সন্ত্রাসবাদী মুসলিমদের সমালোচনা করলে বক্স অফিস সব সময়েই হিট! ঠিক এটাই বিজেপির বাজার। এটাই রোজকার সাম্প্রদায়িকতা।

এই ‘এভরি-ডে’ সাম্প্রদায়িকতার বিপদটাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যেও এই উগ্র হিন্দুয়ানির প্রকোপ বাড়ছে। সেই কারণেই কি বিজেপি বিকাশদাকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টাটাও করছে না এখন? বিকাশদার বদলে প্রাত্যহিক সাম্প্রদায়িকতাই কি তা হলে ২০১৯-এ বিজেপির শেষ পারানির কড়ি?

BJP Communalism Loksabha Election 2018
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy