Advertisement
০৭ মে ২০২৪

শারদ-আকাশে গাঢ় হচ্ছে আশঙ্কার মেঘ

বিষণ্ণতা গ্রাস করছে উৎসবের আলো। চাপা উদ্বেগ, হয়রানি, ছিন্নমূল হওয়ার আশঙ্কায় শরতের ভোরে, শিউলির সুবাসে আগমনী গান বেসুরো ঠেকছে। লিখছেন দীপক সাহাবিষণ্ণতা গ্রাস করছে উৎসবের আলো। চাপা উদ্বেগ, হয়রানি, ছিন্নমূল হওয়ার আশঙ্কায় শরতের ভোরে, শিউলির সুবাসে আগমনী গান বেসুরো ঠেকছে। লিখছেন দীপক সাহা

শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০১:৩৫
Share: Save:

বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব’ গল্পের ছলে পড়াতে গিয়ে পঞ্চম শ্রেণির খুদেদের ক্লাসে এক ভীষণ মনখারাপ করা ঘটনার সাক্ষী রইলাম। ‘তোমাদের কার কার পুজোর নতুন জামাপ্যান্ট হয়েছে?’ জিজ্ঞাসা করতেই পঞ্চাশ জনের মধ্যে মাত্র কুড়ি জন পড়ুয়া হাত তুলল। বাকিরা শূন্যচোখে তাকিয়ে। কারণ জিজ্ঞেস করে যা উত্তর পেলাম তাতে চমকে উঠলাম।

—‘স্যর, আমার বাবা এখনও পাট জাঁক দিতে পারেনি। জল নেই।’

—‘বাবা সোনার দোকানে কাজ করত। তবে এখন কাজ নেই। বাড়িতেই বসে আছে।’

—‘বাড়িতে খুব অশান্তি। বাবা রোজ বিডিও অফিসে যাচ্ছে কী একটা জরুরি কাগজের খোঁজে।’

ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে এলাম। মনের ভিতরটা খচখচ করে উঠল। মুখভার করে থাকা বাচ্চাগুলোকে কোনও আশার আলো দেখাতে পারলাম না। উৎসব মরসুমে বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা এক ঐতিহ্যবাহী গ্রামের শতাব্দী প্রাচীন এক উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এই ছবিটা রাজ্যের সার্বিক অস্থির চিত্রেরই যেন এক প্রতিচ্ছবি।

আর্থিক মন্দার বিষবৃক্ষ গোটা দেশে ডালপালা ছড়িয়েছে। দেশের আর্থিক হাল ঠিক রাখতে অর্থমন্ত্রী সঠিক দিশা দেখাতে ব্যর্থ। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা নিম্নমুখী। গাড়ি ব্যবসা টলমলে। কাশ্মীরে এখনও ফোন ও ইন্টারনেট পরিষেবা পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। পুজোর মরসুমে শ্রীনগরে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ফলপট্টি ঝিমোচ্ছে। নামী বিস্কুটের কোম্পানি মুখিয়ে আছে কখন চাষির হাতে দু’পয়সা হবে। তা হলে তাদের ব্যবসার মন্দা কাটবে। স্বর্ণব্যবসায়ী ও স্বর্ণশিল্পীরা হাত গুটিয়ে বসে আছেন। তাঁত শিল্প ধুঁকছে। এ দিকে পুরো বর্ষাকালটাই গায়েব হয়ে গেল। জলের অভাবে চাষি পাট জাঁক দিতে পারছেন না। ধানচাষ করেও শান্তি নেই। সেচে বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে।

উত্তরবঙ্গে বহু চা বাগান বন্ধ। চা শ্রমিকেরা চরম কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। দক্ষিণবঙ্গে থমকে আছে জুট মিল। সর্বত্র ছাঁটাই আর লক আউটের নোটিস। সঙ্গী শুধু অনিশ্চয়তা। আজ কোনও রকমে খাবার জুটছে তো কাল কী খাবে তার ঠিক নেই। শ্রমিকদের পুজোর মাসে বোনাস তো দূরের কথা, বেতনই জুটছে না। বাড়ির ছোটদের পুজোর জামাকাপড় কেনার বায়না মেটাতে না পেরে আড়ালে চোখের জল লুকোচ্ছেন বাবা-মা।

অন্য দিকে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে বহাল তবিয়তে আছেন শিল্পপতিরা। আর উদয়-অস্ত্্ পরিশ্রম করে যারা দেশের মানুষের মুখে অন্ন জোগাচ্ছেন, ডিজিটাল ইন্ডিয়াকে সচল রাখছেন সেই শ্রমিক, কৃষক, দিনমজুরদের এনআরসির যাঁতাকলে ফেলে চলছে রাজনৈতিক টানাপড়েন। যারা দেশের প্রকৃত চালিকাশক্তি তাঁরাই এখন ছিন্নমূল হওয়ার আশঙ্কায় প্রহর গুনছেন। উৎসবের রোশনাইয়ের ছটা তাঁদের অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনে প্রবেশ করছে না। তাঁদের জীবনে এখন শুধুই হতাশা, অনিশ্চয়তা, হয়রানি আর নিরাপত্তাহীনতা। গণ-আতঙ্কে ছটফট করছে বাংলা।

অর্থনৈতিক মন্দার চোখরাঙানিতে আর শিকড়ের খোঁজ করতে করতে আসন্ন শারদীয়ার সমস্ত উচ্ছ্বাস, আনন্দ চাপা পড়ে যাচ্ছে। শরতের আকাশে গাঢ় হচ্ছে আশঙ্কার মেঘ। পুজোর আর মাত্র ক’দিন বাকি থাকলেও পুজোর বাজার করতে না পারার তীব্র যন্ত্রণায় দগ্ধ হচ্ছেন নদিয়ার খেতমজুর দিনু মাহাতো, কাঁকিনাড়া শিল্পাঞ্চলের শ্রমিক হারান নস্কর কিংবা মুর্শিদাবাদের রানিনগরের পরিযায়ী শ্রমিক শ্রমিক বুধু সর্দার। গোদের উপর বিষফোঁড়া এনআরসি। শাসকের রক্তচক্ষুর হুমকিতে মানুষের যন্ত্রণা বহু গুণ বেড়ে গিয়েছে। নিজের শিকড়ের অস্তিত্বের প্রমাণ বহু পুরানো এক চিলতে হলদেটে কাগজ ঘরের আনাচে-কানাচে তন্নতন্ন করে খুঁজে না পেয়ে মানুষের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ আরও গভীর হচ্ছে।

অস্তিত্ব রক্ষার এক টুকরো কাগজের সন্ধানে বহু লোকজন সকাল-বিকেল পাগলের মতো ছুটছেন এক অফিস থেকে অন্য অফিস। আর তাঁদের হয়রানির আর্তনাদ চাপা পড়ে যাচ্ছে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের কোটি কোটি টাকার বাজেটের পুজোর উদ্বোধনী ফিতে কাটার ধুমে।

পুজোর আর কয়েক দিন বাকি। সারা বছর ব্যবসায়ীরা অপেক্ষা করে থাকেন এই সময়টার জন্য। এ বারে আগমনী বার্তায় নেই খুশির খবর। পুজো বাজারের ভিড় এ বার যেন সরে গিয়েছে সরকারি দফতরে। রেশন, আধার ও ভোটার কার্ড নিয়ে সে এক হইহই কাণ্ড। এ দিকে হাল আমলে অনলাইন ব্যবসা ও শপিং মল মফস্‌সলেও থাবা বসিয়েছে। ফলে পুজো মরসুমে সাধারণ ব্যবসায়ীদের মুখে হাসি উধাও।

এনআরসির হুমকি আর আর্থিক মন্দার জেরে উৎসবের মরসুমে আগের থেকে বিক্রি অনেক কমে গিয়েছে। টান পড়ছে রুজি-রোজগারে। সমাজে একটা আর্থিক অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। আর্থ-সামাজিক কাঠামোয় দেখা দিচ্ছে পরিবর্তন। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাবে এক গভীর সঙ্কটের মুখোমুখি গোটা দেশ।

লেকজন এখন ভাবছেন, আগে তো অস্তিত্ব প্রমাণ, পরে উৎসব। অসহায় বেশ কিছু মানুষ ইতিমধ্যে বেছে নিয়েছেন আত্মহত্যার পথ। বিষণ্ণতা গ্রাস করছে উৎসবের আলো। চাপা উদ্বেগ, হয়রানি, ছিন্নমূল হওয়ার আশঙ্কায় শরতের ভোরে, শিউলির সুবাসে আগমনী গান বেসুরো ঠেকছে। কাশফুলের ঢেউ এ বার আর সাধারণ মানুষের মনে হিল্লোল তুলছে না। শারদীয়া উৎসবের স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাস, আনন্দ এ বার উধাও। শিকড়-সহ আস্তানার প্রমাণপত্র পাওয়ার সমবেত আকুল প্রার্থনা মহালয়ায় পিতৃ-তপর্ণে পূর্বপুরুষদের কাছে। সকলে অপেক্ষা করে আছেন দুর্গতিনাশিনী কবে তাদের এই দুর্গতি বিনাশ করবে; অসুররূপী সমস্ত হয়রানি, অনিশ্চয়তা, উদ্বেগ, আশঙ্কা, ভয়-ভীতি বিদীর্ণ করে মা দুর্গা রাজ্যে বয়ে নিয়ে আসবে আনন্দধারা, শান্তির অমোঘ বাণী।

শিক্ষক, শিকারপুর

উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

NRC Durga Puja 2019
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE