E-Paper

দুর্নীতিচক্র

সত্য-মিথ্যা যাচাই না-করেই প্রলোভনে পা দিয়েছিলেন পরীক্ষার্থীদের একাংশ। সমাজে চিরকালই এক শ্রেণির মানুষ বিপথগামী।

শেষ আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৮:৪২
—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে পশ্চিমবঙ্গের ভাবমূর্তিখানি এমন দাঁড়িয়েছে যে, চাকরিপ্রার্থীদের একাংশও বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, সোজা পথে এই রাজ্যে চাকরিতে প্রবেশের উপায় নেই। উপযুক্ত অর্থ ঢাললে অনায়াসে ‘অন্য’ প্রবেশদ্বারটি উন্মুক্ত হয়ে যায়। ঠিক সেই চিত্রই দেখা গেল সম্প্রতি রাজ্য পুলিশের কনস্টেবল নিয়োগ পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে। পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের টোপ দিয়ে টাকা তোলার ঢালাও আয়োজন করা হয়েছিল পূর্ব বর্ধমানের মানকরে। সেই কু-প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে পুলিশের উদ্যোগে, গ্রেফতারও হয়েছে কয়েক জন। শুধু এই একটি জায়গা নয়, দুই মেদিনীপুরের চাকরিপ্রার্থী পরীক্ষার্থীদেরও দেড় লক্ষ টাকার বিনিময়ে প্রশ্নপত্র এবং উত্তরপত্র দেওয়ার নাম করে ডেকে পাঠানো হয়েছিল দিঘায়। ধরা পড়েছে সেই প্রতারকরাও।

অথচ, যে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের নাম করে এ-হেন প্রতারণার জাল বিস্তার, সেই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র আদৌ ফাঁস হয়নি বলেই জানা গিয়েছে ওয়েস্ট বেঙ্গল পুলিশ রিক্রুটমেন্ট বোর্ডের তরফ থেকে। অর্থাৎ, সত্য-মিথ্যা যাচাই না-করেই প্রলোভনে পা দিয়েছিলেন পরীক্ষার্থীদের একাংশ। সমাজে চিরকালই এক শ্রেণির মানুষ বিপথগামী। তারা বেআইনি পথে প্রাপ্তিলাভে সিদ্ধহস্ত। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক ঘটনাবলির পিছনে শুধুমাত্র এই শ্রেণিটির ‘স্বভাব’কে দায়ী করা চলে না। রাজ্যে যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরির অভাবকেও তা প্রকট করে তোলে। সরকারি স্তরে বহু পদ খালি। কিন্তু নিয়মিত সুপরিচালিত পরীক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে সেই শূন্যপদগুলি পূর্ণ করার সরকারি উদ্যোগ নেই। একটি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে যে পরের বছর পুনরায় পরীক্ষাটিতে বসতে পারা যাবে— তেমন নিশ্চয়তা নেই। হয় পরীক্ষাটিই হবে না, নয়তো সময়ে ফলপ্রকাশ হবে না, ফল বেরোলে দেখা যাবে যোগ্যদের সরিয়ে বিস্তর বেনোজল তার মধ্যে মিশেছে, অথবা সমস্ত বাধা টপকে গেলেও চাকরি পেতে বছর গড়িয়ে যাবে— সব কিছুই গভীর অনিশ্চয়তায় ভরা। সুতরাং আশ্চর্য নয় যে, বহু সৎ, যোগ্য প্রার্থীরাও যেন তেন প্রকারেণ একটি চাকরির জন্য মিথ্যা আশ্বাস, প্রতারণার ফাঁদে পা দেবেন। শিক্ষাক্ষেত্রে অর্থের বিনিময়ে চাকরিপ্রাপ্তির বাজারটি এই সমীকরণেই পুষ্ট হয়েছিল।

প্রশাসন এই বিষয়ে সচেতন ভাবেই নীরব থাকে। দুর্নীতিগ্রস্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে প্রচলিত ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের পথে হাঁটা দূরস্থান, বরং আদালতে দাঁড়িয়ে সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত দলীয় কর্মী-নেতাদের আড়াল করার আপ্রাণ চেষ্টা করে। প্রশাসনের এই নীরব প্রশ্রয়ই সংগঠিত দুর্নীতিকে সমাজের সমস্ত স্তরে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করেছে। সেই দুর্নীতির কারণেই এক ধাক্কায় বাতিল হয়েছিল প্রায় ছাব্বিশ হাজার শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীর চাকরি। অযোগ্যদের পাশাপাশি বহু যোগ্যও চাকরি হারিয়েছিলেন। সম্প্রতি কলকাতা হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের রায়ে বত্রিশ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি বজায় থাকল ঠিকই, তবে দুর্নীতি যে সেখানেও হয়েছে, তা স্পষ্ট। সরকারি ব্যবস্থায় দুর্নীতি, অনিয়ম শুধু যোগ্যদেরই বঞ্চিত করে না, তা প্রশাসনিক কাজকর্মের প্রতি এক বিরাট অনাস্থারও জন্ম দেয়। এই আবহেই অসাধু চক্রগুলি সক্রিয় হয়ে ওঠে। কনস্টেবল নিয়োগের পরীক্ষায় তার একটি ছোট নমুনা দেখা গেল মাত্র।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Unemployment West Bengal Police

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy