E-Paper

ঘুম থেকে উঠে

ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা নিয়ে শিক্ষকেরা ভাবিত হবেন নিশ্চয়ই, সেটিই প্রথম ও প্রধান কথা, কিন্তু শেষ কথা নয়। এই চিন্তা ধাবিত হবে, হওয়া দরকার— শিক্ষার্থীদের শরীর-মন ভাল আছে কি না সেই অভিমুখেও।

শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৫:৪৮

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন একটি কলেজের এক শিক্ষিকার পোস্ট সমাজমাধ্যমে ‘ভাইরাল’ হয়েছে। এক ছাত্র ইমেলে একটি ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ পাঠিয়েছেন তাঁকে, রাত ৩.৪৯-এ। শিক্ষার্থীর নিষ্ঠা ও পরিশ্রমের মুক্তকণ্ঠ প্রশংসা করার পর শিক্ষিকা লিখেছেন, “একটা অনুরোধ, এত রাত জেগে কাজ করার দরকার নেই। রাতের ঘুম না ছেড়েও তুমি চাইলে ঠিক কাজের সময় বার করতে পারবে। কাজের চাপে যদি বিশ্রামটাই না হয়, তবে তার কোনও অর্থ নেই। যে কোনও সাহায্যের জন্য আমি প্রস্তুত, ভাল করে ঘুমিয়ে উঠে আর সকালের খাবার খেয়ে আমাকে ফোন কোরো।” ঘটনাটি জানা গেল, কারণ শিক্ষিকা নিজেই পর দিন এই প্রসঙ্গ টেনে সমাজমাধ্যমে তাঁর ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে লিখেছেন, একটু ভাল ‘প্ল্যানিং’ করলেই যে কাজটা করে ফেলা যায়, তার জন্য তারা যেন রাতের ঘুম ত্যাগ না করে। তারা যেন মনে রাখে, শরীর বিশ্রাম না পেলে অধ্যবসায়ও নিরর্থক; ভাল থাকাটা ‘ডেডলাইন’-এর চেয়ে অনেক বেশি জরুরি।

শিক্ষক দিবসের প্রাক্কালে এ ঘটনা নিতান্ত কাকতালীয়, তবে তার অন্তর্গত বার্তাটি যে কোনও সময়ই প্রাসঙ্গিক। ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা নিয়ে শিক্ষকেরা ভাবিত হবেন নিশ্চয়ই, সেটিই প্রথম ও প্রধান কথা, কিন্তু শেষ কথা নয়। এই চিন্তা ধাবিত হবে, হওয়া দরকার— শিক্ষার্থীদের শরীর-মন ভাল আছে কি না সেই অভিমুখেও। ছাত্রদের ‘ওয়েলবিয়িং’-এর পূর্ণদায়িত্ব শিক্ষকের নয়; শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীরা দিনের যে নির্দিষ্ট সময়টুকু থাকে, সেই সময়টুকুর অভিভাবক নিশ্চিত ভাবেই তাঁরা, তার বাইরের জীবন ও সময়টুকুতে শিক্ষার্থীদের ভাল থাকার দায় শিক্ষকেরা কেন নিতে যাবেন, বা চাইলেও নিতে পারবেন কি না, তর্কের খাতিরে এ যুক্তি উঠতে পারে। কিন্তু প্রকৃত শিক্ষক জানেন, ক্লাসের বাইরে শিক্ষার্থীর জীবনযাত্রা, তার শরীরগতিক-মনমেজাজ ছায়া ফেলে ক্লাসের মধ্যেও। এ কারণেই, শিক্ষার্থীর হৃদয়পুরে জটিলতার খবর যদি বা তাঁর না-ও মেলে, অন্তত শারীরিক ভাবে যেটুকু দৃশ্যমান তার খোঁজখবরের দায় শিক্ষকের উপর বর্তায়। দিল্লির ঘটনাটিতে শিক্ষকের সেই দায় দায়বদ্ধতা হয়ে ফুটে উঠেছে বলেই তা সবার মন কেড়েছে। অন্য বহু শিক্ষক যেখানে ছাত্রের ইমেল পাঠানোর সময়টি খেয়ালই করবেন না, স্রেফ অ্যাসাইনমেন্টের ভালমন্দ বিচারে মন দেবেন, সেখানে তিনি তা শুধু খেয়ালই করেননি, বুঝতে পেরেছেন ছাত্রটি সারা রাত জেগে পড়া তৈরি করেছে, এবং সবচেয়ে বড় কথা, চিন্তিত হয়েছেন এ কাজে তার রাতের ঘুম ও শরীরের বিশ্রাম হল না বলে। অথচ, যে ভাবে-ভঙ্গিতে তিনি শিক্ষার্থীকে তা জানিয়েছেন সেও শিক্ষণীয়— ছাত্রের কর্মনিষ্ঠার প্রশংসায় কার্পণ্য না করেও তিনি তাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, কোন পথে এই অধ্যবসায়ও সার্থক হত, আবার নিদ্রাহরণেরও প্রয়োজন পড়ত না। বুঝিয়েছেন, সবার আগে, পড়াশোনারও আগে নিশ্চিত করা চাই নিজের ভাল থাকা, নিজেকে ভাল রাখা।

এ এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতার ব্যাপার, যার সঙ্গে মিশে আছে সমানুভূতি বা ‘এমপ্যাথি’। এই সমানুভূতির বোধ এক জন শিক্ষকের কাছে সমাজ প্রার্থনা করে আসছে আবহমান কাল ধরে, শিক্ষকেরাও সেই বোধকে জড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন তাঁদের কাজে ও আচরণে। সবাই যে তা পারছেন বা করছেন তা-ও নয়, বহু শিক্ষকের কাছেই শিক্ষকতা শুধুই এক বৃত্তি, ব্রত নয়। আবার দেশ-সমাজ-সংস্কৃতিভেদেও শিক্ষকের দায়দায়িত্বের তর-তম আছে— পাশ্চাত্যের শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কটি মুখ্যত পেশাদার ও নৈর্ব্যক্তিক, ক্লাসরুমের বাইরে শিক্ষার্থীর জীবনে শিক্ষকের ভূমিকা না-ও থাকতে পারে— শ্রেণিকক্ষ, গ্রন্থাগার, গবেষণাগারেই তাঁর সহায়ক সত্তাটি সীমাবদ্ধ। এটা বুঝতে হবে যে, ইউরোপ-আমেরিকায় এক জন শিক্ষার্থী সমাজ ও রাষ্ট্রের থেকে যে ‘সাপোর্ট সিস্টেম’টি পায়, আমাদের দেশে তার কণাটুকুও মেলে না। আমরা বিদেশের শিক্ষাব্যবস্থার বহিরঙ্গটি নিয়েছি; সিলেবাস, সিমেস্টার, রুটিন, প্রোজেক্ট, অ্যাসাইনমেন্ট, এই সব কিছুতে শিক্ষা, বিশেষত উচ্চশিক্ষাকে মুড়ে দিয়েছি। কিন্তু খোঁজ রাখিনি, আমাদের শিক্ষার্থীরা রাতের পর রাত বিনিদ্র জাগছে কি না, কোন বিরাট শারীরিক ও মানসিক ভাঙনের মূল্যে তারা এই শিক্ষার ভার বয়ে চলেছে। এই খোঁজ এক বনিয়াদি, মানবিক খোঁজ। এর জন্য চাই শুধু একটু সহানুভূতি— ‘স্মার্ট’ পেশাদারির সঙ্গে যার কোনও বিরোধ নেই। দিল্লির শিক্ষিকা সেই খোঁজটিই নিলেন। দেখালেন, কাকে বলে খাঁটি শিক্ষকতা, কেমন হবেন প্রকৃত শিক্ষক। ‘ঘুম থেকে উঠে, খেয়ে, ফোন কোরো’— এই তস্য সাধারণ মেসেজে লুকিয়ে যে দরদ, তাকে বুঝতে পারাই শিক্ষা।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Teachers Education

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy