বিধবা ও নিঃসন্তান অবস্থায় কোনও হিন্দু মহিলার মৃত্যু হলে তাঁর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী কে? ভারতের হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে এই প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর আছে— সম্পত্তি পাবেন মহিলার শ্বশুরবাড়ির দিকের আত্মীয়রা। এমনকি, সে সম্পত্তি মহিলার স্বোপার্জিত হলেও তাঁর পিতৃকুলের কারও অধিকার থাকবে না তার উপরে। আইনটি কিন্তু ঔপনিবেশিক আমলের নয়; ১৯৫৬ সালে তা সংসদে পাশ হয়। তর্কযোগ্য ভাবে ভারতীয় গণতন্ত্রের সর্বাপেক্ষা উদার কালপর্বে, যখন প্রধানমন্ত্রীর আসন উজ্জ্বল করতেন জওহরলাল নেহরু। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলা দায়ের হয়েছিল, এই আইনের সাংবিধানিকতাকে প্রশ্ন করে। আদালত সেই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে অরাজি হয়েও দেশের সব হিন্দু মহিলার কাছে আর্জি জানিয়েছেন, তাঁরা যেন অবশ্যই নিজেদের উইল বা ইচ্ছাপত্র রচনা করেন। একবিংশ শতকের এক-চতুর্থাংশ অতিক্রম করেও কোনও মহিলাকে তাঁর যাবতীয় অন্য পরিচয় থেকে বিচ্ছিন্ন করে কেন শুধু স্বামীর পরিচয়েই দেখা হবে, এই অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটিকে যদি আপাতত বকেয়া রাখা যায়, তা হলে শীর্ষ আদালতের এই পরামর্শটিকে কী ভাবে দেখা বিধেয়?
ইচ্ছাপত্র রচনা করা হল মৃত্যুর পরেও নিজের অর্জনের উপরে নিজের এজেন্সি বা অধিকার বজায় রাখার সুষ্ঠুতম পথ। বিষয়টি নিতান্ত অজানাও নয়— গল্প-উপন্যাস বা সিনেমায় উইলের প্রসঙ্গ এসেই থাকে। কিন্তু, তার পরও ভারতে ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ কোনও ইচ্ছাপত্র রচনা না করেই মারা যান। অনুমান করা চলে, মহিলাদের মধ্যে এই হার আরও বেশি। উইল তৈরি না করার অন্যতম কারণ হল, এ বিষয়ে সচেতনতার অভাব। এমনকি উচ্চশিক্ষিত, দায়িত্বশীল পদে কর্মরত মহিলারাও যথেষ্ট সচেতন নন। রাষ্ট্র এই সচেতনতা বৃদ্ধিতে উদ্যোগী হবে, এমন আশা করা কঠিন। ফলে, সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শটিকে যদি কার্যকর করতে হয়, তবে সেই দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে নাগরিক সমাজকেই— বিশেষত, নারী অধিকারকেন্দ্রিক সংগঠনগুলিকে। তার একটি পথ অবশ্যই প্রচার। পথসভা থেকে ছোট গোষ্ঠীতে নির্দিষ্ট আলোচনা, সংবাদপত্রে লেখালিখির মতো পরিচিত প্রচারের বিকল্পের পাশাপাশি এখন এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে সমাজমাধ্যম। সচেতনতার একটি স্বাভাবিক গতিজাড্য আছে— এক বার তার পরিবেশ তৈরি হতে থাকলে পরবর্তী ধাপগুলি স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে গতিশীল হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। আরও একটি দায়িত্বও গ্রহণ করতে পারে নাগরিক সমাজ। আচরণবাদী অর্থনীতি যাকে ‘নাজ’ বলে, সে পথে হাঁটা যায়। অর্থাৎ, বিভিন্ন পরিসরে, বিভিন্ন সূত্রে মেয়েদের মনে করিয়ে দেওয়া যে, ইচ্ছাপত্র তৈরি করা তাঁদের এজেন্সির একটি অপরিহার্য অঙ্গ।
কিন্তু, তাতেও কি গোটা পথ হাঁটা যাবে? বিশ্বব্যাপী অভিজ্ঞতা বলে যে, আর্থিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মেয়েরা গুটিয়ে থাকেন। এমনকি, যেখানে স্বামী-স্ত্রী সমান কৃতী, সমান উপার্জনশীল, সেখানেও বড় মাপের আর্থিক সিদ্ধান্ত স্বামীরাই গ্রহণ করেন, স্ত্রীর সম্মতিক্রমেই। বাড়ি-গাড়ি কেনা থেকে মাসিক সঞ্চয় বা বিনিয়োগ, সিদ্ধান্ত মূলত পরিবারের পুরুষের হয়। এবং, বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, স্থায়ী সম্পদ কেনার ক্ষেত্রে যাঁর টাকাই ব্যবহৃত হোক, তাতে মালিক হিসাবে নাম থাকে পুরুষের। ঘটনাগুলি এমনই ‘স্বাভাবিক’ যে, পরিবারের পরিসরে সচরাচর কেউ তা নিয়ে প্রশ্নও তোলেন না। যে কোনও আধিপত্যবাদী ব্যবস্থার মতোই পুরুষতন্ত্রও এমন সম্মতি নির্মাণের মাধ্যমেই কাজ করে। ‘আর্থিক দুনিয়াটি পুরুষের’, এমন লিঙ্গভিত্তিক ধারণার পিছনে যে আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি রয়েছে, তা বহুলাংশে পাল্টে গেলেও ধারণাটি যে পাল্টায়নি, সেখানেই আধিপত্যবাদের জয়। অতএব, মেয়েদের মধ্যে শুধু উইল রচনার সচেতনতা প্রচার করতে চাইলেই যথেষ্ট হবে না। নিজেদের আর্থিক জীবনের অধিকার যে তাঁদের বুঝে নিতে হবে, সচেতনতা প্রয়োজন এই মৌলিক স্তরে। পুরুষতান্ত্রিক পরিবার-কাঠামো তাতে নিশ্চিত ভাবেই বাধা দেবে। কোনও ক্ষেত্রে সে বাধা আসবে প্রত্যক্ষ বিরোধের রূপে; কোথাও আবার তা ভালবাসা অথবা অভিমানের রূপ ধারণ করবে। নিজের আর্থিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার নিজে বুঝে নেওয়ার প্রশ্নটি যে ভালবাসার অভাব নয়, অথবা জীবনসঙ্গীর প্রতি বিশ্বাসের ঘাটতিজনিত নয়, বরং তা প্রতিটি মেয়ের আত্মপরিচয়ের অঙ্গ, এই বিশ্বাসটি মেয়েদের জীবনে প্রোথিত করা জরুরি। সে পথে যে কোনও প্রকট বা প্রচ্ছন্ন বাধাই আসলে নারী ক্ষমতায়নের পক্ষে অবশ্য-পরিহার্য প্রতিবন্ধক।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)