বিধ্বস্ত পাহাড়। প্রবল বৃষ্টিপাতের পর নদীতে জলের তোড়ে ভেসে গেল রাস্তা, সেতু, ঘরবাড়ি। বহু প্রাণহানির খবর এখনই মিলেছে; আশঙ্কা, সংখ্যাটি আরও বাড়বে। রাজ্যের এক প্রান্তে যখন এমন বিপর্যয় চলছে, তখন অন্য প্রান্তে মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে দুর্গাপুজোর ‘কার্নিভাল’-এ মেতে থাকা শোভন হল কি না, সে প্রশ্ন অন্যত্র বিচার্য। এই মুহূর্তে প্রধান প্রশ্ন হল, কী ভাবে এমন বিপর্যয় ঘটতে পারে? রাজ্য প্রশাসনের তরফে বৃষ্টিপাতের প্রাবল্যের কথা বলা হচ্ছে। ৩০০ মিলিমিটারের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত সামান্য কথা নয়, ঠিকই— কিন্তু, উত্তরবঙ্গের পাহাড় আগে কখনও এমন বৃষ্টিপাতের সাক্ষী থাকেনি, তা তো নয়। আসলে যা ঘটেছে, রাজ্য প্রশাসনের পক্ষে সে কথা স্বীকার করা মুশকিল— রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায়, প্রশাসনিক ঔদাসীন্যে হিমালয়ের অতি ভঙ্গুর বাস্তুতন্ত্রের সর্বনাশ হয়েছে। উত্তরাখণ্ড বা হিমাচল প্রদেশ বিষয়ে এ কথাটি যেমন সত্য, উত্তরবঙ্গের জন্যও তেমনই সত্য। পাহাড়ে যত্রতত্র বাড়ি উঠেছে কোনও নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করেই; অতি সংবেদনশীল অঞ্চলে গড়ে উঠেছে রিসর্ট। পাহাড়ি ঝোরার মুখ বন্ধ করে জমি দখল করা হয়েছে; নদী থেকে ক্রমাগত পাথর চুরির ফলে বদলে গিয়েছে নদীর খাতই। গাছ কাটা হয়েছে খেয়ালখুশি মতো। ফলে, মাটি ক্রমশ আলগা হয়েছে, বেঁধে রাখার ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। আর একই সঙ্গে পাহাড়ি নদী সমতলে নামার পর তার নাব্যতা হ্রাস পেয়েছে। সব মিলিয়ে, অতিপ্রবল বৃষ্টিপাতের পর পাহাড়ে নদীতে যখন হঠাৎ করে জলের পরিমাণ বেড়েছে, তখন সেই জল দ্রুত নীচের দিকে নামতে পারেনি; তা নদীখাত ছাপিয়ে দু’কূল ভাসিয়েছে। যথেষ্ট গাছ থাকলে, মাটি শক্ত থাকলে সেই ধাক্কা সামলানো যেত— যে-হেতু তা নেই, ফলে জলের স্রোতে ভেসে গিয়েছে ঘরবাড়ি, রাস্তা, সেতু। প্রকৃতির প্রতিশোধের চরিত্র এমনই নির্মম।
পরিস্থিতি সামলাতে নেমেছে রাজ্য প্রশাসন; সেনাবাহিনীও তৎপর হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী সপারিষদ উত্তরবঙ্গ সফরে গিয়েছেন। অনুমান করা চলে, বেশির ভাগ রাস্তা সারিয়ে ফেলা যাবে কিছু দিনের মধ্যে। মৃতদের জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা হবে; যাঁদের ঘরবাড়ি ভেসে গিয়েছে, তাঁদেরও পুনর্বাসন হবে কোনও না কোনও ভাবে। কিন্তু, তাতে এই সমস্যা মিটবে কি? না কি পরবর্তী বিপর্যয়ের জন্য দিন গুনবে উত্তরবঙ্গ? যে কারণগুলির জন্য আজ এই অবস্থা হয়েছে, তার কোনওটিই প্রাকৃতিক নয়— সবই রাজনৈতিক অর্থনীতিসঞ্জাত। তার মধ্যে রাষ্ট্রের ‘উন্নয়ন-ভাবনা’ রয়েছে— কেবলমাত্র তিস্তার উপরেই নির্মিত বাঁধের সংখ্যা এক হাতের কড়ে গুনে শেষ করা যাবে না। রয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ— রাজনৈতিক যোগাযোগ এবং টাকার জোর থাকলেই যেখানে ইচ্ছা, যত বড় ইচ্ছা বাড়ি তৈরি করা যায়, ফেঁদে বসা যায় হোটেল বা হোম-স্টে’র ব্যবসা। এবং রয়েছে অকৃত্রিম চুরিও— নদীখাতের পাথর, বালি, অরণ্যের গাছ, সবই চুরি করা হয় নির্দ্বিধায়। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক অর্থনীতির যে চরিত্র এখন প্রশ্নাতীত, সেই অবৈধ খাজনা আদায়ের প্রবণতা আজ উত্তরবঙ্গের হিমালয় অঞ্চলকে এই বিপদের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে। বিপর্যয় ঘটার পর আপৎকালীন ত্রাণ কর্মসূচির মাধ্যমে এই সমস্যার কোনও সমাধান হবে কি? উত্তরটি বিলক্ষণ জানা। সমাধানের পথ অন্যত্র। তার জন্য খাজনা আদায়ের নীতিটি পরিত্যাগ করতে হবে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এই দাবি করার কোনও অর্থ হয় না যে, পাহাড়ে কোনও রকম ‘উন্নয়ন’ চলবে না। কিন্তু, তার জন্য কোনও রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক বিবেচনা নয়, বিশেষজ্ঞদের মতামতকে শিরোধার্য করতে হবে। প্রতিটি সিদ্ধান্তের আগে সম্ভাব্য পরিণতি সমীক্ষা করা জরুরি। মনে রাখতে হবে, নবীন ভঙ্গিল পর্বত হিমালয়ের উপরে জোরজুলুম করলে প্রকৃতি বহু গুণে তা ফেরত দেবে। সেই ধাক্কা সামলানোর ক্ষমতা যে মানুষের নেই, বিপর্যস্ত দার্জিলিং জেলা এই মুহূর্তে সেই সত্যের সাক্ষ্য বহন করছে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)