E-Paper

শিবির-সর্বস্ব

প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, যেখানে সরকারি সাধারণ অ্যাম্বুল্যান্সের অভাবে হামেশাই হেনস্থার শিকার হয় রোগীর পরিবার, প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম মাতৃযান চলে, সেখানে এই পরিমাণ টাকায় সর্বাগ্রে সেই খামতিগুলিকে দূর করার উদ্যোগ করা হল না কেন?

শেষ আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৬:৪৩

মোট ২১০টি মোবাইল মেডিক্যাল ইউনিট গাড়ি, এক-একটির দাম চল্লিশ লক্ষ। অর্থাৎ, সর্বমোট ব্যয়ের পরিমাণ আশি কোটি টাকারও বেশি। এই পরিমাণ অর্থব্যয়ে স্বাস্থ্য দফতরের উদ্যোগে পশ্চিমবঙ্গে শুরু হয়েছে ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা শিবির (এমএমইউ)। কার্যত সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার সমান্তরালে গড়ে ওঠা এমন কর্মসূচি অবশ্য রাজ্যে নতুন নয়। ইতিপূর্বে নিজ নির্বাচনী এলাকায় ‘সেবাশ্রয়’ নামে প্রায় অনুরূপ একটি কর্মসূচি চালু করেছিলেন তৃণমূল সাংসদ তথা দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ব্যয় হয়েছিল কয়েক কোটি টাকা। অংশগ্রহণ করেছিলেন প্রায় বারোশো চিকিৎসক। প্রশ্ন উঠেছিল, এই আয়োজনে বিপুল সংখ্যক মানুষের সাড়া দেওয়া কি বাস্তবে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্দশা এবং তার প্রতি সাধারণ মানুষের অনাস্থার চিত্রটিকেই প্রকট করে তোলে না? তারও পূর্বে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে ‘দুয়ারে ডাক্তার’ কর্মসূচিতে পশ্চিম মেদিনীপুরে স্বাস্থ্যশিবির করতে পাঠানো হয়েছিল এসএসকেএম-এর চিকিৎসকদের। সেই সময়ও প্রশ্ন উঠেছিল, রাজ্যের বর্তমান স্বাস্থ্য পরিকাঠামোকে সংস্কারের মাধ্যমে উন্নততর না করে, সাময়িক শিবিরে প্রকৃত কোনও লাভ হয় কি? একই ধাঁচের প্রশ্ন স্বাস্থ্য দফতরের এই নবতম উদ্যোগকে ঘিরেও উঠছে। প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, যেখানে সরকারি সাধারণ অ্যাম্বুল্যান্সের অভাবে হামেশাই হেনস্থার শিকার হয় রোগীর পরিবার, প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম মাতৃযান চলে, সেখানে এই পরিমাণ টাকায় সর্বাগ্রে সেই খামতিগুলিকে দূর করার উদ্যোগ করা হল না কেন?

এই নতুন উদ্যোগকে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার ‘পরিপূরক’ বলেও দাবি করা চলে না। যেখানে মূল ভিত্তিটিই নড়বড়ে, সেখানে পরিপূরক ব্যবস্থা গড়ে উঠবে কী করে? ভ্রাম্যমাণ স্বাস্থ্য শিবির প্রয়োজন হয় দুর্গম, প্রত্যন্ত স্থানের জন্য, অথবা কোনও বিপর্যয়-অন্তে, যেখানে ভ্রাম্যমাণ পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ কিছু পরিষেবা, যা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সহজলভ্য নয়, তার জন্যও এই ব্যবস্থা করা যায়। কিন্তু সাধারণ চিকিৎসা, যার পরিকাঠামো যে কোনও প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে থাকার কথা, তার জন্য পৃথক আয়োজন করে অর্থব্যয় কেন? অন্য দিকে, এই শিবিরগুলিতে চিকিৎসার জন্য যে চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়ে যাওয়া হয়, তাঁরা সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থারই অঙ্গ। এমনিতেই জেলার স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে যথেষ্ট সংখ্যক চিকিৎসকের দেখা পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ ওঠে। যাঁরা আছেন, তাঁদেরও যদি শিবিরমুখী হতে হয়, তবে সরকারি হাসপাতাল সামলাবেন কে? তা ছাড়া সাময়িক শিবির করে বা ভ্রাম্যমাণ পরিষেবায় রোগনির্ণয়, পরামর্শ দেওয়ার কাজটি করা যায়, রোগের অনুসারী চিকিৎসা প্রদান সেখানে সম্ভব নয়। তার জন্য রোগীদের সেই সরকারি হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্রেরই দ্বারস্থ হতে হয়। অথচ, সেগুলিই পরিকাঠামোর অভাবে ধুঁকতে থাকে। উপযুক্ত চিকিৎসা সরঞ্জাম, কর্মীর অভাবে বড় হাসপাতালে ‘রেফার’-এর রোগও সারে না। বিষয় যেখানে জনস্বাস্থ্য, সেখানে নতুন কোনও উদ্যোগ করতে হলে এবং সরকারি তহবিল থেকে অর্থবরাদ্দ করতে হলে পর্যাপ্ত আলোচনা প্রয়োজন। নতুন ব্যবস্থাটি আদৌ প্রয়োজনীয় কি না, কত জন এর দ্বারা উপকৃত হতে পারেন, তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা প্রয়োজন। অন্যথায়, শিবির-শেষে রাজনৈতিক চমকটুকুই পড়ে থাকে, জনস্বাস্থ্যের হাল ফেরে না।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Duare Daktar Duare Doctor Sebaashray medical treatment Public Health

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy