বৃষ্টির অভাবে ঘনিয়েছে কৃষিসঙ্কট।
জলবায়ু পরিবর্তন দুয়ারে থেমে নেই, এসে দাঁড়িয়েছে বাংলার ধানের খেতে। শ্রাবণ পেরিয়ে ভাদ্র এসে গেলেও বাংলার বহু চাষি আমন ধান লাগাতে পারেননি। কয়েক লক্ষ হেক্টর জমিতে এ বছর জলের অভাবে শেষ পর্যন্ত ধান রোয়া হবে না। বীরভূম, পুরুলিয়ায় অর্ধেকেরও বেশি জমিতে চাষ বাকি, মালদহ এবং মুর্শিদাবাদে এক-তৃতীয়াংশ জমিতে। যে সব জমিতে ধান রোয়া হয়ে গিয়েছে, সেখানেও উৎপাদন নিয়ে অনিশ্চিত চাষিরা— বৃষ্টির বিলম্বে বীজের ক্ষতি হয়েছে। শুধু বাংলায় নয়, গাঙ্গেয় উপত্যকা জুড়েই বৃষ্টির অভাবে এ বার কৃষিসঙ্কট ঘনিয়েছে। ঝাড়খণ্ডে তীব্র খরা, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গে বৃষ্টি-নির্ভর চাষিরা বিপন্ন, প্রধানত সেচ-সেবিত এলাকাগুলিতে চাষ হয়েছে। এই চারটি রাজ্য ভারতের আশি শতাংশ ধান উৎপাদন করে। কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রকের হিসাব অনুসারে, অগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় চুয়াল্লিশ লক্ষ হেক্টর জমিতে ধান চাষ হয়নি, মোট চাষের এলাকা গত বছরের চেয়ে বারো শতাংশ কম। ধান বোনা হয়েছে যে দু’কোটি ত্রিশ লক্ষ হেক্টরে, বর্ষার অভাবে সেখানেও ফলন নিয়ে সংশয় রয়েছে। ফলে ধানের উৎপাদনে ঘাটতি এক কোটি টন ছাড়ানোর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। একেই এ বছর বসন্তে অতিরিক্ত উষ্ণতার জন্য গমের উৎপাদনে এতই ঘাটতি হয়েছে যে, মে মাস থেকে সরকার গমের রফতানি বন্ধ করেছে। রেশন ব্যবস্থায় গমের ঘাটতি পূরণ করা হচ্ছে চাল দিয়ে। এখন ধানের উৎপাদনেও ঘাটতি হলে খাদ্যশস্য আমদানিতে বিদেশি মুদ্রা ব্যয় করতে হওয়ার আশঙ্কা।
এমন খাদ্যসঙ্কট যে অপ্রত্যাশিত নয়, সে বিষয়ে আগেই সতর্ক করেছিল জলবায়ু সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের (আইপিসিসি) রিপোর্ট। এ বছর মার্চে প্রকাশিত রিপোর্ট জানিয়েছিল, ২০৫০ সালের মধ্যে ধান, গম, ডাল-সহ খাদ্যশস্যের উৎপাদন ন’শতাংশ অবধি কমে যেতে পারে। উচ্চ তাপমাত্রা এবং ঘন ঘন দুর্যোগ— যেমন খরা, অতিরিক্ত বৃষ্টি, বন্যা— কৃষিকে ব্যাহত করবে। অনেক রাজ্য ইতিমধ্যেই চাষের ধরন বদলাচ্ছে— ধান চাষে জল বেশি লাগে বলে ছত্তীসগঢ়, ওড়িশা এবং হরিয়ানা চাষিদের ডাল, বাজরার মতো শস্যের দিকে প্রণোদিত করছে। তেলঙ্গানা, তামিলনাড়ুতে বেশি লাভের আশায় চাষিরা ঝুঁকছেন তুলো, ভুট্টার মতো শস্যে। বছরের মাঝামাঝি চালের দাম গত বছরের তুলনায় প্রায় সাত শতাংশ চড়েছে।
বাংলাতে জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় কিছু চাষি সরে যাচ্ছেন ধানের দেশি প্রজাতির দিকে। দেশি ধান পরিবেশ-বান্ধব, চড়া উষ্ণতা ও দীর্ঘ প্লাবন সহ্য করতে পারে তুলনায় অনেক বেশি, তাই অনেক বিশেষজ্ঞ তা চাষের পরামর্শ দিচ্ছেন। কোনও কোনও এলাকায় তার সুফলও প্রমাণিত। কিন্তু ব্যাপক হারে তা গ্রহণ করা উচিত, না কি সুস্থায়ী চাষের জন্য অন্য কৌশল দরকার, তা নিয়ে এখনও যথেষ্ট আলোচনা হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের চাষিরা রাজ্যের প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ধান উৎপাদন করেন। কিন্তু যে-হেতু বর্ষার চাষ থেকেই অধিকাংশ চাষি নিজেদের প্রয়োজনের ধান সংগ্রহ করে রাখেন, তাই উৎপাদনে ঘাটতি যথেষ্ট উদ্বেগজনক। চালের দাম বাড়লে তাঁরা বিপন্ন হবেন। কেবল অনুদানের অর্থ নয়, বাংলার চাষির এখনই প্রয়োজন সুস্থায়ী, লাভজনক চাষের নীতি ও প্রশিক্ষণ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy