স ংস্কার, নাকি সর্বনাশ? কেন্দ্রীয় সরকার ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট-এর সংস্কার করতে যে নতুন আইন আনছে, তার বয়ান দেখে ক্ষুব্ধ আইএসআই-এর শিক্ষকরা প্রশ্ন তুলেছেন। ১৯৩১ সালে কলকাতায় প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের তৈরি এই প্রতিষ্ঠান শিক্ষা এবং গবেষণার উৎকর্ষে এখন সারা বিশ্বে পরিচিত। শাখা তৈরি হয়েছে দিল্লি, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই এবং তেজপুরে। অথচ, ‘আধুনিক’ করার নামে আইএসআই-এর স্বাতন্ত্র্য খর্ব করে, তাকে কেন্দ্রীয় সরকারের বশীভূত, আমলাতান্ত্রিক একটি সংস্থায় পরিণত করাই যেন আইনের উদ্দেশ্য। খসড়া আইন চায় ক্ষমতাশালী প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করতে— বোর্ড অব গভর্ন্যান্স-এর এগারো জনের মধ্যে সাত জনই হবেন সরকার-মনোনীত সদস্য। অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য সংখ্যা (বর্তমানে তেত্রিশ) কমবে, সদস্যদের মনোনীত করবে বোর্ড অব গভর্ন্যান্স। অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের ভূমিকা হবে কেবলমাত্র উপদেষ্টার। বর্তমানে কাউন্সিলে সাত জন শিক্ষক রয়েছেন, তাঁদের সংখ্যা সম্ভবত কমবে। শিক্ষকদের আশঙ্কা, এর ফলে আইএসআই কার্যত কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। পাঠ্যক্রম নির্মাণ, প্রতিষ্ঠানের নীতি নির্ধারণে শিক্ষকদের ভূমিকা দুর্বল হবে। বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে আইনের আরও একটি বক্তব্য— আর্থিক ভাবে স্বনির্ভর হতে হবে আইএসআই-এর শাখাগুলিকে, তাই ছাত্রদের থেকে ফি নিতে হবে। বর্তমানে বিনা পয়সায়, বা অতি স্বল্পমূল্যে বেশ কিছু বিষয় পড়তে পারছেন ছাত্রছাত্রীরা। এ ক্ষেত্রেও প্রশ্ন উঠেছে, নতুন গবেষণা, উচ্চমানের পঠনপাঠন হচ্ছে যে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, সেগুলির ব্যয়ভার কেন সরকার গ্রহণ করবে না? কেন খরচের বোঝা চাপবে ছাত্রছাত্রীদের কাঁধে?
আইএসআই নিয়ে প্রস্তাবিত আইন উচ্চশিক্ষায় কেন্দ্রের অবস্থান নিয়ে সংশয়-সন্দেহের বাতাবরণকে আরও গাঢ় করল। গত কয়েক বছরে নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিরুদ্ধে আপত্তি উঠেছে যে, সংস্কারের নামে শিক্ষা ও গবেষণার সব প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় সরকার নিজের আয়ত্তাধীন করতে চায়। এক দিকে প্রতিষ্ঠানগুলির স্বাতন্ত্র্যের, স্বায়ত্তশাসনের পরিসর সঙ্কীর্ণ হয়ে এসেছে, অন্য দিকে খর্ব হয়েছে রাজ্যগুলির ভূমিকা। উপাচার্য নিয়োগের নিয়ম, বিশ্ববিদ্যালয়গুলির জন্য টাকা বরাদ্দের বিধি, ভর্তি পরীক্ষার কেন্দ্রীকরণ, ইউজিসি বা নাক-এর মূল্যায়নের মাধ্যমে একই ধরনের পরিকাঠামো আরোপ, জাতীয় শিক্ষা নীতির (২০২০) মাধ্যমে সব রাজ্যে একই ধরনের পাঠ্য বিষয় আনার চেষ্টা— সবই সেই কেন্দ্রীকরণের অঙ্গ। সংবিধানে শিক্ষার স্থান যৌথ তালিকায়, সেখানে কেন্দ্রের এই আধিপত্যের চেষ্টা বার বার সমালোচিত হয়েছে। প্রস্তাবিত আইএসআই আইন— যার খসড়া প্রকাশিত হয় সেপ্টেম্বর ২০২৫-এ— সেই ধারাতেই আরও একটি সংযোজন।
নরেন্দ্র মোদী সরকারের আইন প্রণয়নের আরও একটি লক্ষণ, আলোচনাহীনতা। আইএসআই-এর সর্বস্তরের শিক্ষক ও প্রশাসকদের সঙ্গে যথেষ্ট আলোচনা না করে, তাঁদের মতামত না জেনে একটি খসড়া বিল প্রস্তুত করা হল, মতামত জানানোর জন্য সময় দেওয়া হল মাত্র মাসখানেক। কেন এই সংলাপহীনতা? কেনই বা উচ্চশিক্ষায় আমলাদের প্রাধান্য দেওয়ার এই ঝোঁক? আজকাল পঠনপাঠনের উৎকর্ষ, কিংবা নতুন জ্ঞান, নতুন উদ্ভাবনের সন্ধানের চেয়ে প্রতিষ্ঠান ব্যস্ত হয়ে পড়ে বিধিপালনের দিকে। প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখার রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন পরিচালকরা। বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে সরকারি দফতর। গবেষণা প্রতিষ্ঠান তখনই সফল, সার্থক হয়, যখন তাকে চালিত করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ইচ্ছা। সব প্রতিষ্ঠানকে এক নিয়মে গেঁথে ফেলার প্রশাসনিক ঝোঁক তার ঠিক বিপরীতে ঠেলে দেয় শিক্ষাকে। এই আদর্শ-বিচ্যুত, আনন্দহীন শিক্ষার ধারণাকেই রবীন্দ্রনাথ বিদ্ধ করেছিলেন ‘তোতাকাহিনী’ গল্পে। আজ তার পুনরভিনয় চলছে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)