ভারতে নির্দিষ্ট কিছু এক বার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক, থার্মোকল জাতীয় সামগ্রীর উৎপাদন এবং ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়েছিল ২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে। তারও আগে ২০১৮ সালের ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শুনিয়েছিলেন এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী পদক্ষেপের কথা— ২০২২ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রমে এক বার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের কবল থেকে মুক্ত হবে দেশ। তদনুযায়ী নিষেধাজ্ঞায় সুস্পষ্ট ভাবে জানানো হয়েছিল কোন ধরনের প্লাস্টিক সামগ্রী নিষিদ্ধ হবে। রাজ্যগুলিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়, এই সামগ্রীর উৎপাদন, মজুত ও বিক্রির বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর। অতঃপর তিন বছর অতিক্রান্ত। সেই নিষেধাজ্ঞার ভূমিকাটি যে ক্ষেত্রবিশেষে নেহাতই অন্তঃসারশূন্য, অন্তত এই রাজ্যে তার প্রমাণ বাজার, দোকান, সমাবেশ, উৎসবস্থল সর্বত্রব্যাপী। খোদ শাসক দলের বাৎসরিক সর্ববৃহৎ জনসমাবেশ-অন্তেও দেখা যায়, শহরের ঠিক মধ্যিখানে, অদূরের সবুজ ময়দানে নিষিদ্ধ ব্যবহৃত সামগ্রী চতুর্দিকে ছড়ানো। ফলে রাজ্য প্রশাসনের সদিচ্ছার পরিমাণ সহজেই বোধগম্য।
প্লাস্টিকের সামগ্রী নিষিদ্ধকরণের ক্ষেত্রে তার উৎসে নিয়ন্ত্রণ আবশ্যক। উৎপাদন ও মজুতের প্রক্রিয়াটিকে আটকাতে না পারলে, ব্যবহারে রাশ টানা বা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজটি যথাযথ ভাবে সম্পন্ন হবে না। অথচ, এ রাজ্যে কোন ইউনিটগুলি এই নিষিদ্ধ প্লাস্টিক উৎপাদনের কাজ করছে, সেই তালিকায় এখনও স্বচ্ছতার যথেষ্ট অভাব। কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তালিকা অনুযায়ী ৬০টি ইউনিট নিষিদ্ধ সামগ্রী উৎপাদনের কাজ করছিল। কিন্তু তার মধ্যে ৪৪টির হদিস পাওয়া গেলেও ১৬টির অস্তিত্ব সরকারের রেকর্ডে নেই। হয় এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট তালিকাটিতেই অসঙ্গতি রয়েছে, নয়তো রাজ্য পুলিশের নজরদারি ও তথ্য সংগ্রহের কাজটি ত্রুটিপূর্ণ। গাফিলতি কোন তরফে তা দ্রুত নির্ণয় করে তদনুযায়ী ব্যবস্থা আবশ্যক। কারণ ‘নেই’ ইউনিটগুলি নীরবে নিষিদ্ধ প্লাস্টিক সামগ্রীর জোগান অব্যাহত রাখলে ধরপাকড় আর বাজেয়াপ্ত করার চটজলদি ব্যবস্থায় দীর্ঘমেয়াদি সমাধান সম্ভব হবে না। এ দিকে রাজ্য নগরোন্নয়ন ও পুর বিষয়ক দফতরের রিপোর্টেই দেখা গিয়েছে, কলকাতা, বিধাননগর, বালি-সহ একাধিক পুরসভা বেআইনি প্লাস্টিকের বিক্রি ও ব্যবহারের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে এক টাকাও জরিমানা আদায় করেনি। অথচ, উত্তর দমদম, পানিহাটি, চুঁচুড়া, বর্ধমানের মতো পুরসভা এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট সফল। যেখানে কোনও বিষয়ের সঙ্গে সামগ্রিক ভাবে পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্যের প্রসঙ্গটি জড়িত, সেখানে ব্যতিক্রমের অবকাশ থাকতে পারে কি?
অবশ্য, মুখ্য উদ্দেশ্য যদি হয় জনমোহিনী রাজনীতি এবং দলীয় তহবিলের উদরপূর্তি, তবে এই নিষ্ক্রিয়তা অস্বাভাবিক নয়। যে কারণে রাজ্যে এখনও নিষিদ্ধ বাজি উৎপাদন, বিক্রি, ব্যবহারে রাশ টানা যায় না, সেই ‘রুজি-রোজগার’-এর কুযুক্তি এবং ‘কাটমানি’র আশ্বাসেই পার পেয়ে যায় নিষিদ্ধ প্লাস্টিকও। অনিয়ন্ত্রিত, অব্যবস্থাপনার শিকার সামগ্রীগুলি স্তূপাকার হয় নদীর পাড়ে, নালা-নর্দমার মুখ বন্ধ করে জল জমার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। একটু-একটু করে বিষ ঢোকে মানবশরীরে, দূষণে ধুঁকতে থাকে পরিবেশ, আর পুর-প্রশাসন মিথ্যা প্রতিশ্রুতির জাল বোনে। এই কুচক্র থেকে মুক্তি দূর অস্ত্।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)