Advertisement
০৪ মে ২০২৪
Indian Judiciary

লজ্জা

কলকাতা হাই কোর্টের আইনজীবীরা বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে তাঁর এজলাসে যে ভাবে আটকে রেখে বিক্ষোভ দেখালেন, এ রাজ্যের ন্যায়ালয়ে তা বেনজির।

শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০২২ ০৪:৫১
Share: Save:

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি যেন প্রতি দিনই নীচতার নতুন নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে। বিচারপতির রায় কারও পছন্দ না-ই হতে পারে— সে ক্ষেত্রে উচ্চতর আদালতে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে— কিন্তু কলকাতা হাই কোর্টের আইনজীবীরা বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে তাঁর এজলাসে যে ভাবে আটকে রেখে বিক্ষোভ দেখালেন, তেমন কালো অধ্যায় এ রাজ্যের ন্যায়ালয়ে বেনজির। ১২ এপ্রিল আইনজীবী সংগঠনের দু’পক্ষের হাতাহাতি বেধেছিল। পরের দিন তাঁদেরই এক পক্ষ এজলাসের দরজা অবরোধ করলেন, অন্য আইনজীবীদের সেখানে ঢোকার পথে হেনস্থা করলেন, চিৎকার করে শুনানিতে বাধা দিলেন। সংবাদে প্রকাশ, বিক্ষোভকারীরা রাজ্যের শাসক দল ঘনিষ্ঠ। স্কুল সার্ভিস কমিশনে নিয়োগ সংক্রান্ত মামলায় বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় যে সব নির্দেশ দিচ্ছেন, তা তাঁদের দলের পক্ষে স্বস্তিদায়ক না হওয়াতেই তাঁরা চটেছেন। প্রশ্ন হল, ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশ নিয়ে বিচারপতির প্রশ্ন তোলার ঘটনাকে আইনজীবীরা ভ্রান্ত মনে করতেই পারেন— সে ক্ষেত্রে পথ হল সুপ্রিম কোর্টে যাওয়া। ঘেরাও করে বিক্ষোভ দেখানোর অর্থ তো বাহুবল প্রদর্শন! তা কি আইনের স্বাভাবিক পথ?

যদিও রাজ্যের অতীত বলবে, শুধু বিচারব্যবস্থা নয়, গণতন্ত্রের প্রতিটি স্তম্ভকেই অষ্টপ্রহর এমন পেশিশক্তির সঙ্গে যুঝতে হয়। বিধানসভায় দিনের পর দিন কুনাট্য চলেছে। অধিবেশনকে দর-কষাকষির মঞ্চে পর্যবসিত করেছে বিরোধী দল বিজেপি; তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদস্বরূপ বাজেট অধিবেশনের মতো জরুরি আলোচনাতেও তারা অনুপস্থিত। তাদের উপস্থিতি যদিও পরিস্থিতি আরও ঘোরালো করেছে— শাসক-বিরোধী চাপানউতোরে রাজ্যপাল ভাষণ দিতে পারেননি, রামপুরহাট কাণ্ডের প্রেক্ষিতে দু’দলের হাতাহাতিও বেধে গিয়েছে। অন্য দিকে, সাম্প্রতিক পুরভোটে সংবাদমাধ্যম যে ভাবে আক্রান্ত হল, কিংবা রাজ্যের হিংসার ঘটনার প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রশাসনের রোষানলে পড়ল, তা-ও রাজ্যের গণতন্ত্রের পক্ষে গৌরবের কথা নয়। উল্লিখিত ঘটনাগুলিতে পুলিশ-প্রশাসনের নিরপেক্ষতাও প্রশ্নের মুখে পড়েছে। সার্বিক ভাবে রাজ্যের গণতান্ত্রিক পরিবেশ যে বিপদের মুখে পড়েছে, হাই কোর্টের ঘটনা তারই ধারাবাহিকতা।

পশ্চিমবঙ্গের এই সঙ্কট যদিও অভূতপূর্ব নয়। তা আসলে অতি-রাজনীতির বিপদ। দীর্ঘ দিন ধরেই এই রাজ্যের সমাজে শেষ কথা বলতে চেয়েছে রাজনীতি, তৎসূত্রে ক্ষমতার আস্ফালনই সারসত্য হয়ে উঠেছে। আর তার হাত ধরেই ক্রমশ অনিবার্য হয়ে উঠেছে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নও, যার প্রতিফলন সমাজের আর কোনও স্তরেই অগোচর থাকে না। মনে পড়বে, বামফ্রন্ট আমলে গ্রামে-গ্রামে গৃহস্থের হেঁশেল পর্যন্ত নাগাল ছিল লোকাল কমিটির। উপাচার্য নিয়োগ থেকে স্বাস্থ্যনীতি— আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের অঙ্গুলিহেলন ব্যতিরেকে প্রশাসন তথা সমাজের কোনও অলিন্দে পাতাটিও নড়ত না। একদা নাগরিক সমাজের দুর্বার আন্দোলন রাজনীতির একাধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল বটে, কিন্তু জমানা বদলে পুনর্মূষিকো ভব। অতএব, আবারও রাজনীতির বিষনজর এড়িয়ে থাকা কারও পক্ষেই সম্ভব হয় না। পরিত্রাণের উপায়ও তাই সুদূরপরাহত, দিনে-দিনে অগণতন্ত্রের কলুষতায় ডুবে যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Indian Judiciary West Bengal Law
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE