পথে নিশ্চিন্তে, নিরাপদে হাঁটার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের আছে। অথচ, পথকুকুরপ্রেমীদের একাংশ সেই বিষয়টি মনে রাখতে চান না। তাঁরা যত্র তত্র কুকুরদের খাওয়ান, ফলত পথঘাট যথেষ্ট অপরিষ্কার হয়, প্রতিবাদ করতে গেলে তাঁরা বচসায় জড়িয়ে পড়েন। তাঁদের প্রশ্রয়ে জনবসতিপূর্ণ এলাকায় কুকুরদের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটে অন্যদের বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতা হাই কোর্ট প্রশাসনকে একদা নির্দেশ দিয়েছিল— নির্দিষ্ট স্থানে পথকুকুরদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে। অবশেষে প্রশাসনের টনক নড়েছে। হাই কোর্টের নির্দেশানুসারেই সম্প্রতি রাজ্যের নগরোন্নয়ন দফতর পথকুকুরদের খাওয়ানো নিয়ে নির্দিষ্ট কার্যবিধি নির্মাণ করেছে। জানানো হয়েছে— প্রতি ওয়র্ডে পুরসভা চিহ্নিত নির্দিষ্ট জায়গাতেই পথকুকুরদের খেতে দিতে হবে, শিশুদের খেলার জায়গা বা জনসমাগমের জায়গায় নয়। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দিনে দু’বার তাদের খাওয়ানো যাবে। এবং সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, খাওয়ানো হয়ে গেলে সেই জায়গাটি পরিষ্কার করে দিতে হবে। নির্দিষ্ট জায়গার বাইরে কোথাও খাওয়ানো হলে অথবা পথ অপরিচ্ছন্ন রেখে দেওয়া হলে সংশ্লিষ্ট পক্ষ শাস্তির মুখে পড়বেন।
এই নির্দেশিকা স্বাগত। পথকুকুরদের সকলেই বাধ্য, আদবকায়দা সম্পন্ন হবে, আশা করা অন্যায়। প্রায়শই তাদের কারণে পথচলতি মানুষকে, বিশেষত রাতবিরেতে বিস্তর বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। সুতরাং, এই মানুষরা যদি পথকুকুরদের এড়িয়ে শান্তিতে চলাফেরা করতে চান, তবে তাঁদের সে অধিকার থেকে বঞ্চিত করা চলে না। পথকুকুরদের উপর অত্যাচার যেমন শাস্তিযোগ্য অপরাধ, তেমনই তাদের অবাধ প্রশ্রয়দানের ফলে অন্যের ক্ষতি সাধিত হলে সেটিও অমার্জনীয়। এ ক্ষেত্রে এক সুচিন্তিত ভারসাম্য প্রয়োজন, যা বিস্মৃত হওয়াই যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। পথকুকুরদের আক্রমণে নিহত, আহতের ঘটনাগুলিও উপেক্ষা করার নয়। বছর দুয়েক আগে নয়ডায় এক দল কুকুরের আক্রমণে এক বহুতল আবাসনের চৌহদ্দির মধ্যে সাত মাসের শিশুর মৃত্যুর ঘটনা স্মরণীয়। সেই সময়ও দায়িত্বজ্ঞানহীন ভাবে জনবসতি এলাকায় কুকুরদের খাওয়ানোর বিষয়টি আলোচনায় উঠে এসেছিল। জানা গিয়েছিল, শুধু ২০২২ সালেই সারা দেশে ত্রিশটি শিশু পথকুকুরদের আক্রমণে নিহত হয়েছে, অধিকাংশ শিশু নিম্নবিত্ত পরিবারের।
অন্য দিকে, পথকুকুরদের মাধ্যমে জলাতঙ্ক ছড়ানোর উদ্বেগটিও উপেক্ষণীয় নয়। জলাতঙ্ক রোধে পথকুকুরদের নির্বীজকরণ এবং তাদের প্রতিষেধক দানের প্রক্রিয়াটিকে জোরদার করা প্রয়োজন। পশ্চিমবঙ্গে সেই কর্মসূচি কাঙ্ক্ষিত গতি পেয়েছে কি? ইতিপূর্বে মেয়র ফিরহাদ হাকিম পথকুকুরদের সংখ্যাবৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সেই সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে তাঁরা কী করছেন, তার স্পষ্ট উত্তর মেলেনি। অবশ্যই পথকুকুরদেরও খাওয়ার, যত্ন পাওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু তাকে ঘিরে অ-নিয়ম চলবে না। অবিলম্বে পুরসভাগুলিকে নির্দেশিকা অনুসারে জায়গা নির্দিষ্ট করতে হবে। নাগরিকদেরও মনে রাখতে হবে, খাবার ছুড়ে দিলেই নিজেকে পশুপ্রেমী প্রমাণ করা যায় না। তারা যাতে পরিচ্ছন্ন পরিবেশে বেড়ে উঠতে পারে, নিয়মিত প্রতিষেধক, পুষ্টিকর খাবার পায়— সেগুলিও নিশ্চিত করা জরুরি। সমাজে মানুষ এবং গৃহপালিত প্রাণীদের সহাবস্থান শান্তিপূর্ণ করতে পথান্তর নেই।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)