E-Paper

গোষ্ঠী, না ব্যক্তি

তফসিলি জাতিগুলির মধ্যে সাংবিধানিক স্তরে সমতা এবং ঐতিহাসিক-সামাজিক স্তরে অসমতার যে দ্বন্দ্ব ছিল, তার নিরসন ভারতীয় সংরক্ষণ ব্যবস্থায় সম্ভব হয়নি।

শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০২৪ ০৮:৪৪
—প্রতীকী চিত্র।

—প্রতীকী চিত্র।

আম্বেডকর-প্রণীত সংবিধানে যে-হেতু সংরক্ষণের মধ্যে ‘ক্রিমি লেয়ার’-এর জন্য বিশেষ কোনও ব্যবস্থার নির্দেশ নেই, ফলে তারা সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ গ্রহণ করবে না বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। দেশের সংবিধানের প্রতি এ-হেন শ্রদ্ধার নিদর্শন বর্তমান শাসকদের আচরণে সুলভ নয়, ফলে অনুমান, সংবিধানের আদর্শ রক্ষা ব্যতীত ক্ষুদ্রতর রাজনৈতিক কারণ রয়েছে। কিন্তু, গুরুতর প্রশ্ন এই মুহূর্তে রয়েছে— সংরক্ষণের মধ্যে কি আদৌ সংরক্ষণ সম্ভব? সুপ্রিম কোর্টের সাত সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ এ মাসের গোড়ায় যে মামলায় রায় দিল, সেটি ই ভি চিন্নায়া ভার্সেস স্টেট অব অন্ধ্রপ্রদেশ অ্যান্ড আদার্স মামলায় ২০০৪ সালে সুপ্রিম কোর্টেরই পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চের একটি রায়ের পুনর্বিবেচনার মামলা ছিল। ২০০৪ সালের সেই রায়টি অন্ধ্রপ্রদেশ সরকারের শিডিউলড কাস্ট (র‌্যাশনালাইজ়েশন অব রিজ়ার্ভেশনস) অ্যাক্ট ২০০০-কে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে জানায় যে, সংরক্ষণের মধ্যে সংরক্ষণের ব্যবস্থা অসাংবিধানিক। ২০২৪ সালের রায় এই রায়টিকেই নাকচ করল। ফলে, শুধু সংরক্ষিত শ্রেণির মধ্যে থাকা অর্থনৈতিক ভাবে অগ্রসর (ক্রিমি লেয়ার) জনগোষ্ঠীর জন্য সংরক্ষণের প্রশ্নই নয়, খুলে গেল আর একটি বহু পুরনো প্রশ্নের পরিসরও— তফসিলি জাতিভুক্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যেও যে জাতিগুলি বিবিধ সামাজিক কারণে অধিকতর পশ্চাৎপদ, তাদের জন্য কি বিশেষ ভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা যায়? প্রশ্নটির গুরুত্ব অনস্বীকার্য, কারণ সংবিধান অনুসারে বেশ কিছু জাতি নবম তফসিলের অন্তর্ভুক্ত হলেও সামাজিক পরিসরে তাদের বঞ্চনার পরিমাপ সমান ছিল না। সেই জাতিগুলির মধ্যেও সম্পর্কের উচ্চাবচতা ছিল। ফলে, তফসিলি জাতিগুলির মধ্যে সাংবিধানিক স্তরে সমতা এবং ঐতিহাসিক-সামাজিক স্তরে অসমতার যে দ্বন্দ্ব ছিল, তার নিরসন ভারতীয় সংরক্ষণ ব্যবস্থায় সম্ভব হয়নি। সাংবিধানিক বেঞ্চের রায়ের পর সেই তর্ক স্বভাবতই ফিরে আসবে।

অর্থনৈতিক ভাবে ‘ক্রিমি লেয়ার’ এবং সামাজিক ভাবে অতিবঞ্চিত, সংরক্ষণের আওতায় থাকার এই দুই আপাত ভাবে বিপরীতমুখী শ্রেণির জন্য সংরক্ষণের বিশেষ ব্যবস্থার ভাবনা একটি ভিন্নতর প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়— এখনও কি সংরক্ষণের মাপকাঠি হিসাবে শুধুমাত্র জাতিপরিচয়ই ব্যবহৃত হবে? যে ঐতিহাসিক বঞ্চনার প্রতিকার সূত্র হিসাবে সংরক্ষণের কথা ভাবা হয়েছিল, সেই ভিত্তিটিকে অস্বীকার করার কোনও প্রশ্নই নেই। কিন্তু, সে ভিত্তিটিই যথেষ্ট কি না, তা ভাবা প্রয়োজন। প্রথমত, ‘ক্রিমি লেয়ার’ কি জাতিগত পরিচিতি অনুসারে নির্ধারিত হবে, অর্থাৎ কোনও কোনও সংরক্ষিত জাতিকে তাদের সার্বিক আর্থিক অবস্থার বিবেচনায় সংরক্ষণের আওতা থেকে বাদ দেওয়া হবে? অথবা ধরা যাক, এমন কিছু ব্যক্তি আছেন, যাঁরা জাতিগত পরিচয়ে তফসিলি জাতিরও অতিবঞ্চিত অংশের অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু আর্থিক ভাবে সচ্ছল। তাঁরা কি তবে অতিবঞ্চিত পরিচয়ে বিশেষ সংরক্ষণের অধিকারী হবেন, না কি তাঁর আর্থিক সচ্ছলতা তাঁদের ‘ক্রিমি লেয়ার’-এর অন্তর্ভুক্ত করবে, এবং তাঁরা সংরক্ষণের সুবিধা হারাবেন? এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করতে গেলে কি গোষ্ঠীপরিচয়ের পরিবর্তে ব্যক্তিপরিচয়কেই গুরুত্ব দেওয়া বিধেয়? ভারতীয় সংবিধান সম্বন্ধে এই প্রশ্নটি তোলার আরও একটি তাৎপর্য আছে— কেননা সংবিধানের দর্শন শেষ অবধি ব্যক্তিনাগরিককেই গ্রাহ্য করে, কোনও গোষ্ঠীপরিচয়কে নয়। সংরক্ষণ এই দর্শনের একটি তাৎপর্যপূর্ণ ব্যতিক্রম— এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণে এই ব্যতিক্রম করা হয়েছিল। ভাবা যেতে পারে যে, সংবিধান প্রণয়নের পর সাড়ে সাত দশক সময় অতিক্রম করে এসে সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও ব্যক্তিপরিচয়কেই গুরুত্ব দেওয়া উচিত কি না। তবে, সেই ভাবনার কাজটি আইনসভার, বিচারবিভাগের নয়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আলোচনার মাধ্যমে নতুন পথের সন্ধান করা জরুরি।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Supreme Court India

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy