E-Paper

নির্মম সত্য

হাসপাতালে আসা ভিড়ের মধ্যে শিশুদের লক্ষ্যনির্ণয় এদের খুবই চেনা কৌশল এবং বার বার সেই কৌশল কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। তা সত্ত্বেও হাসপাতালের নিরাপত্তার এ-হেন শিথিলতা বহু প্রশ্নের জন্ম দেয়।

শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০২৫ ০৬:০২

নিখোঁজ শিশুদের তালিকায় পশ্চিমবঙ্গ এগিয়ে। এই দুর্ভাগ্যময় সংবাদ মিললেও পরিসংখ্যান অমিল— ঠিক কত শিশু প্রতিনিয়ত পাচার হয়ে চলেছে। কিছু সময় অন্তরই শিশু চুরি সংক্রান্ত খবর শিরোনামে আসে। গত মাসেই হুগলির একটি হাসপাতাল ও বর্ধমানের মেডিক্যাল কলেজ থেকে নবজাতক চুরির চেষ্টা হয়। শিশু দু’টিকে উদ্ধার করা হয়, দোষীরা ধরা পড়ে। এ বার খাস কলকাতার বি সি রায় হাসপাতাল থেকে চুরি গেল চিকিৎসা করতে আসা ছ’মাসের শিশুপুত্র। চুরিগুলিতে একটি ছকের আভাস মেলে। অপরাধী শিশুর পরিবারের সঙ্গে আলাপ-পরিচয়ের মাধ্যমে ভরসা জয়ের চেষ্টা করে শিশুকে নিয়ে পালানোর সুযোগ খোঁজে। অর্থাৎ, তাদের সামনে রেখে বড় কোনও পাচার চক্রের সক্রিয়তা সম্ভব। কিছু পাচারচক্র ধরাও পড়ে। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের জাল ছড়িয়ে আছে আন্তঃরাজ্য স্তরে। হাসপাতালে আসা ভিড়ের মধ্যে শিশুদের লক্ষ্যনির্ণয় এদের খুবই চেনা কৌশল এবং বার বার সেই কৌশল কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। তা সত্ত্বেও হাসপাতালের নিরাপত্তার এ-হেন শিথিলতা বহু প্রশ্নের জন্ম দেয়।

সৌভাগ্য, এ বারও শিশুপুত্রটিকে কয়েক ঘণ্টা পরেই উদ্ধার করা গিয়েছে। চুরিতে পাচার চক্র জড়িত কি না, সেই তদন্তও চলছে, যেমন আশ্বাস প্রতি ক্ষেত্রেই মেলে। যত শিশু খোয়া যায়, তার বহুলাংশকেই ফেরানো যায়— এই দাবিতে পরিস্থিতির ভার লাঘবের চেষ্টাও পরিচিত। কিন্তু, অন্তঃতদন্ত আঙুল তুলেছে, পাচারচক্রগুলি বিভিন্ন স্তরের স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে যোগসাজশ রাখে। বহু দম্পতিই সুস্থ সন্তান জন্মের পর হঠাৎ তার মৃত্যুর খবরে স্তম্ভিত হন। আশঙ্কা প্রবল, খবর প্রশাসন পর্যন্ত পৌঁছনো দূর, হয়তো অভিভাবকও জানতে পারেন না যে সন্তান চুরি গিয়েছে। শিশুর নিরাপত্তার স্বার্থেই দত্তক প্রক্রিয়াটিকে দীর্ঘ ও বহুস্তরীয় রাখার ফলে বহু নিঃসন্তান দম্পতিই ধৈর্য ধরতে পারেন না বা নির্বাচিত হন না। সন্তানের সঙ্গে সম্পত্তি ও বংশরক্ষার বিশ্বাস জুড়ে দেওয়ার সামাজিক প্রবণতাটি তাঁদের বিচলিত করে। ফলে, অর্থের বিনিময়ে সহজে সন্তানলাভে মরিয়া হওয়া অসম্ভব নয়। পিতৃতান্ত্রিক দেশে পাচারতালিকায় পুত্রসন্তানের গুরুত্ব এই তত্ত্বের সাক্ষ্য। গর্ভ ভাড়ায় কঠিন নিয়ম পরোক্ষ ভাবে শিশুর চাহিদা আরও বাড়াতে পারে। স্বল্প বেতনের শ্রমে নিয়োগ, শৈশব থেকে অপরাধী-প্রশিক্ষণের দুরভিসন্ধি ছেলে-শিশু চুরির অন্যতম কারণ। হারানো মেয়েদের অধিকাংশেরই স্থান হয় যৌনপল্লিতে। তুমুল আর্থিক বৈষম্যসম্পন্ন এই দেশে ন্যায়বিরুদ্ধ উপার্জনের রাস্তা নির্মাণ করছে শিশুপাচার।

এর প্রতিরোধ কিন্তু সেই তিমিরেই। দেশে রোজগারের সংস্থান বাড়ানো, নিঃসন্তান দম্পতিকে দত্তক প্রথা প্রসঙ্গে ওয়াকিবহাল রাখা এবং পদ্ধতিটিকে স্বচ্ছ অথচ যথাসম্ভব সরল রাখা সেই প্রতিরোধের জরুরি ধাপ। হাসপাতাল, স্টেশন ও নানা গুরুত্বপূর্ণ গণপরিসরে নজরদারি, নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে শিশু ও তার পরিবারের সুরক্ষা প্রশাসনিক দায়। কর্মীদের কঠোর জবাবদিহির আওতায় আনা, নিয়োগের সময় ভাল ভাবে খোঁজখবর করলে স্বাস্থ্য দফতরের তরফেও বিপদ কিছুটা ঠেকানো যায়। দুষ্কৃতীরা কী উপায়ে শিশুহরণ করছে, তা নিয়ে ব্যাপক প্রচার প্রয়োজন। সভ্য রাষ্ট্রে শিশু পণ্য হয়ে উঠলে তা মানবাধিকারের উল্লঙ্ঘন, আন্তর্জাতিক আঙিনায় জাতীয় অপমান।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Child Trafficking Child theft Child Safety

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy