Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
BJP

বিদ্বেষবিষ

অতি সম্প্রতি কেন্দ্রকে কড়া কথা শুনিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট, কেন্দ্র ও রাজ্যগুলিকে বলেছে যে কোনও ঘৃণাভাষণকারীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করতে অভিযোগ দায়েরের অপেক্ষা না করেই।

প্রতীকী ছবি।

শেষ আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০২২ ০৫:৫৭
Share: Save:

বছর মুড়োতে চলল, কিন্তু কথা ফুরোচ্ছে না। কথা অর্থাৎ কুকথা। দেশ জুড়ে বিজেপির মন্ত্রী সাংসদ বিধায়ক থেকে স্থানীয় নেতা সবার মুখে ঘৃণাভাষণ— কিছু দিন পর পরই ফিরে আসছে, কোভিডের ঢেউ যেন। তার স্বভাবচরিত্রও অতিমারির মতো: সর্বপ্লাবী ও সাংঘাতিক, সময়ে রাশ না টানলে জীবনাশঙ্কা। কর্নাটকে প্রকাশ্য সভায় বিজেপির সাংসদ প্রজ্ঞা ঠাকুর বললেন রান্নাঘরের ছুরিতে শাণ দিয়ে রাখতে, ছুরি দিয়ে ভাল করে আনাজ কাটা গেলে ‘শত্রু’র মাথাও কাটা যাবে। কে শত্রু, কেনই বা, তার ব্যাখ্যা নেই, ঘৃণার অস্ত্রের মুখে তা নিষ্প্রয়োজনও। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ সিংহ অবশ্য সেই রাখঢাকটুকুও করেননি, ডিসেম্বরের গোড়ায় উত্তরপ্রদেশে এক সভায় বিহারের মুসলমান-অধ্যুষিত সীমাঞ্চলকে সোজাসুজিই বলেছেন ‘বাংলাদেশ’। নাগরিকের বিরুদ্ধে, মানুষের বিরুদ্ধে অনর্গল বিদ্বেষের চাষ করছেন জননেতা ও প্রতিনিধিরাই, মুর্শিদাবাদের এক বিজেপি নেতা সভামঞ্চ থেকে নির্দেশ দিয়েছেন পঞ্চায়েত নির্বাচনে পকেটে ব্লেড, বাড়িতে সর্ষের তেল মাখানো লাঠি, আঁচলে লঙ্কাগুঁড়ো রাখতে, সময়ে কাজে দেবে।

বিরোধী দলগুলির প্রতিবাদ, নাগরিক সমাজের অসন্তোষ, এমনকি বিচারবিভাগের কড়া চেতাবনিতেও বিজেপির নেতামন্ত্রীদের কুকথাস্রোতে যে বাঁধ দেওয়া যাচ্ছে না, তার কারণ এক দিকে বিজেপির হাতে থাকা ক্ষমতার নিরাপত্তাবলয়, অন্য দিকে এই ঘৃণাকেই অতি দক্ষতায় রাজনীতির জটিল সমীকরণ সমাধানে ব্যবহার করতে পারার চতুর কৌশল। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ীই কিছু কাল পর পর নেতা-মন্ত্রীদের মুখে বিদ্বেষবিষ ফিরে ফিরে আসে, রাজ্যে রাজ্যে ভোটের আগে নির্বাচনী জনসভায় বেড়ে যায়, ভোটে জিতলে শান্ত হয় সাময়িক ভাবে। সম্প্রতি গুজরাত বিধানসভা ভোট-বৈতরণির অনেকাংশ বিজেপি পার করেছে এর সহায়েই: দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বয়ং সেখানে কুকথার দায়িত্ব নিয়েছিলেন, ২০০২-এর গুজরাত দাঙ্গাকে বলেছিলেন ‘উচিত শিক্ষা’। তাঁকে যোগ্য সঙ্গত করেছিলেন হিমন্ত বিশ্বশর্মা ও যোগী আদিত্যনাথ— লাভ জেহাদ থেকে সন্ত্রাসবাদ, নানা অনুষঙ্গ ও ইঙ্গিতে। তাতে বিজেপির লাভই হয়েছে, কথার বিষে হিন্দু-মুসলমান মেরুকরণ তীব্র করে কার্যোদ্ধার হয়েছে। ২০২৩-এ কর্নাটক ও মধ্যপ্রদেশ-সহ ন’টি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন, তার মধ্যে কর্নাটক নিয়ে বিরোধী কংগ্রেস অনেকটাই আত্মবিশ্বাসী। কর্নাটকের সভায় প্রজ্ঞা ঠাকুরের ছুরিতে শাণ দেওয়ার বার্তা তাই বিজেপির বহুব্যবহৃত কৌশলেরই সময়োচিত পুনঃপ্রয়োগ, বললে অত্যুক্তি হবে না। আগামী বছরে ঘৃণাভাষণের এই অস্ত্রপ্রয়োগ বাড়বে বই কমবে না, বিজেপির রাজনৈতিক প্রয়োজনেই।

ঘৃণা ও হিংসার এই মারাত্মক সংক্রমণ থেকে কি তবে ভারতের মুক্তি নেই? মনে রাখা দরকার, দেশে সর্বব্যাপী ঘৃণার আবহ নিয়ে অতি সম্প্রতি কেন্দ্রকে কড়া কথা শুনিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট, কেন্দ্র ও রাজ্যগুলিকে বলেছে যে কোনও ঘৃণাভাষণকারীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করতে— অভিযোগ দায়েরের অপেক্ষা না করেই। অন্যথায় তা হবে আদালত অবমাননার শামিল, শাস্তিযোগ্য। সুপ্রিম কোর্ট-সহ ভারতের নানা আদালত গত কয়েক বছর ধরে বহু বার ঘৃণাভাষণ নিয়ে মন্তব্য করেছে, নির্দেশও দিয়েছে। কিন্তু তার পরেও দেশ জুড়ে এর অনর্গল প্রয়োগই বুঝিয়ে দেয়, শুধু বিচারব্যবস্থার সদিচ্ছা ও সক্রিয়তায় কাজ হবে না, যদি না গণতন্ত্রের অন্য দুই স্তম্ভ, বিশেষত শাসনব্যবস্থা— আদালতের নির্দেশ কানে নেয়। ঘৃণাভাষণ রুখতে প্রয়োজন নির্দিষ্ট ও কঠোর আইনও, উপযুক্ত আইন নেই বলেই নেতা-মন্ত্রীদের কুকথার এত বাড়বাড়ন্ত। শীর্ষ আদালতের আদেশ কবে প্রকৃত অর্থে কার্যকর হবে, ঘৃণাভাষণে অভিযুক্ত কেউ আর ক্ষমতার জোরে পার পাবেন না, আপাতত সেই অনাগতের দিকে চেয়ে থাকা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

BJP Hate speech controversy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE