তুমি বসন্তের কোকিল, তোমার কুহুধ্বনিতে আর ভুলিতেছি না। পাঁচ বৎসর অন্তর মধুর সুরে কখনও ‘খেলা হবে’, কখনও বা ‘সোনার বাংলা’ গাহিতেছ, উহাতে ভবি ভুলিবার নহে। হে পরভৃত, তোমার ধর্ম ইহাই। শতবর্ষেরও আগে বৃদ্ধ কমলাকান্ত চক্রবর্তী তোমার এই কুহকিনী গুণটি সম্পর্কে আমাদের সতর্ক করিয়া গিয়াছিলেন: “এ পৃথিবীতে গ্ল্যাডস্টোন, ডিস্রোলির ন্যায় তুমি কেবল গলাবাজিতে জিতিয়া গেলে। গলাবাজির এত গুণ না থাকিলে যিনি বাজে নবেল লিখিয়াছেন, তিনি রাজমন্ত্রী হইবেন কেন? আর জন স্টুয়ার্ট মিল পার্লিয়ামেন্টে স্থান পাইলেন না কেন?” কিন্তু এখন বিধানসভার ভোট আসিয়াছে, তোমার গলার জোর বাড়িয়াছে। কখনও বলিতেছ, বাড়ি বাড়ি রেশন পৌঁছাইয়া দিবে, কখনও বা পরিবারপিছু এক জনের চাকরি। কখনও বলিতেছ, ক্ষমতায় আসিলে সকলকে নাগরিকত্ব দিয়া দিবে, কখনও বলিতেছ মেয়েদের বাসের টিকিট আর কাটিতে হইবে না। এই সকল গালভরা মধুর প্রতিশ্রুতিতে বাঙালি বিশ্বাস করে, এমন নিশ্চয় তুমি ভাবিতেছ না? পত্রপল্লববেষ্টিত বৃক্ষচূড়া হইতে নামিয়া ভূমিতে দাঁড়াও। দেখিবে, মানুষ তোমাকে চিনিয়াছে বিলক্ষণ, তোমার কুহুরবে ভুলিতেছে না। এই ভোটবসন্তে তোমাকে আর্থিক বৃদ্ধি, শিল্পে পুনরুজ্জীবন ইত্যাদি যে গান গাহিতে হইবে, গাহিয়া যাও। তোমার অবস্থা আমরা বুঝি। অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করিয়া পাঁচ বৎসর অন্তর মধুর প্রতিশ্রুতির কুহুতানই তোমার বিহঙ্গধর্ম।
হে কোকিল, তুমি কাকের বাসায় পালিত হইয়া পিতৃপুরুষকে ভুলিয়াছ। নহিলে দেখিতে, নির্বাচনী বসন্তে তোমার ওই সোনার বাংলা গড়ার গানের সহিত রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক অতি ক্ষীণ। হর্ষদ মেহতা, টেলিকম, হাওলা কেলেঙ্কারির পর বাম রাজত্বে, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস এই আওয়াজটি তুলিয়াছিল। প্রত্যুত্তরে সিপিএম দেওয়াল লিখিয়াছিল: ‘আগে সামলা হাওলা/ পরে গড়বি বাংলা’। জনস্মৃতি বরাবর দুর্বল, ভোটবসন্তে নির্বাচনী ছড়ার সেই মেধাযুদ্ধ আর নাই, এখন কেবল ‘খেলা হবে’ বা ‘টুম্পা সোনা’র ডিজে-সঙ্গীত। অতীতের সেই নির্বাচন হইতে আরও উদাহরণ দেওয়া যায়। কেন্দ্রের তৎকালীন শাসক কংগ্রেস স্লোগান তুলিয়াছিল, ‘স্থায়ী সরকার করে এগিয়ে নিতে দেশ/ একটিমাত্র দল, তার নাম কংগ্রেস’। এক দেশ, এক দল, এক সরকারের বিধান নূতন নহে। কিন্তু পদ্ধতিটি নূতন। তাই এক দেশ, এক দলের সঙ্গে মাঝে মাঝে আজকাল হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান কুহুতানও গাহিতে হয়। তবে মনুষ্যসমাজ স্লোগানের পিকধ্বনিতে গুঞ্জরিত হয় না, সেখানে অদলবদল ঘটিয়া চলে। পুরাতন কালের একদা যুযুধান দুই দল এখন জোটশরিক। বর্তমান কালের প্রতিপক্ষ হয়তো কোনও কালে শরিক হইবে। তুমি কী করিবে। তোমার কুহুতান একই রকম প্রতিশ্রুতিসর্বস্ব থাকিবে, তুমি ভোটবসন্তে একই ভাবে মন ভোলাইবার নেশায় মাতাল হইবে। এবং তবু মন ভোলাইতে পারিবে না বুঝিয়া উদ্ভ্রান্ত বোধ করিবে
তোমার দোষ নাই, কোকিল। ইহা বসন্ত ঋতুর চিরাচরিত অভিশাপ। প্রথম অনুচ্ছেদে কমলাকান্ত নামে যে আফিমখোর ব্রাহ্মণের কথা লিখিয়াছি, সে কেবল তোমার কুহুতানের কথা বলে নাই। বসন্তের রাঙা শিমুল ফুলের কথাও বলিয়াছিল— ‘এ দেশে এক জাতি লোক সম্প্রতি দেখা দিয়াছেন, তাঁহারা দেশহিতৈষী বলিয়া খ্যাত।... যখন ফুল ফোটে, তখন দেখিতে শুনিতে বড় শোভা।’ সে চেতাবনি দিয়াছিল, ‘চৈত্র মাসে, রোদের তাপে অন্তর্লঘু ফল ফট করিয়া ফাটিয়া ওঠে।’ এই নববসন্তে সেই দেশহিতৈষীরা ফাটিয়া-ফুটিয়া সর্বত্র তুলার ন্যায় ছড়াইয়া পড়িয়াছেন। আপন গাছে থাকিয়া তাঁহারা দেশহিতৈষণার কাজ করিতে পারিতেছিলেন না। রাঙা শিমুল এবং তোমার অন্তঃসারশূন্য কুহুতানেই বাঙালির আবার সিনেমার গান মনে পড়িল: ‘বসন্ত এসে গেছে’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy