E-Paper

পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থে

ম্প্রতি সংশোধিত ওয়াকফ আইনটিকে ঘিরে যে ধর্মীয় উগ্রতা আর অশান্তির আগুন জ্বলে উঠেছিল, তা ভাল করে লক্ষ করলে বোঝা যায়, কতটাই সঠিক জায়গা বেছে নেওয়া হয়েছিল সাম্প্রদায়িক অশান্তি ও হিংসা তৈরির জন্য।

শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০২৫ ০৪:৪৮

ফরাক্কা, শমসেরগঞ্জ হয়ে সুতি আর জঙ্গিপুর: চারটি বিধানসভা নিয়ে এই অঞ্চলটিকে বলা যায়, পশ্চিমবঙ্গের নিজস্ব ‘চিকেন নেক’ অর্থাৎ দুর্বলতম জায়গা। এই অঞ্চলের এক দিকে অরক্ষিত বাংলাদেশ সীমান্ত, অন্য দিকে ঝাড়খণ্ড, এক এক জায়গায় রাজ্যের ভূমির প্রস্থ দশ কিলোমিটারেরও কম, তার সঙ্গে রয়েছে গঙ্গা-পদ্মার যুগ্ম অববাহিকা। সম্প্রতি সংশোধিত ওয়াকফ আইনটিকে ঘিরে যে ধর্মীয় উগ্রতা আর অশান্তির আগুন জ্বলে উঠেছিল এই অঞ্চলে, তা ভাল করে লক্ষ করলে বোঝা যায়, কতটাই সঠিক জায়গা বেছে নেওয়া হয়েছিল সাম্প্রদায়িক অশান্তি ও হিংসা তৈরির জন্য। ‘তৈরি’ শব্দটিই এখানে প্রযোজ্য, কেননা পুরো ঘটনায় পূর্ব পরিকল্পনার ছাপ স্পষ্ট। সন্দেহ নেই, রাজ্য রাজনীতি-কেন্দ্রিক মেরুকরণের তাস হিসাবে সাম্প্রতিক সংঘর্ষের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু কেবল সেইটুকু দিয়েই বিষয়টির বিচার করা যাবে না। কেননা কেবল এই একমাত্রিক বিচারে একটি বৃহত্তর প্রশ্ন— জরুরি প্রশ্ন— নজর এড়িয়ে যেতে পারে।

ইতিমধ্যেই রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের পদক্ষেপ থেকে স্পষ্ট, অশান্তির পরিকল্পনায় দেশের বাইরের শক্তির হাতের আশঙ্কা করা হচ্ছে। গোয়েন্দারা খতিয়ে দেখছেন বাংলাদেশি দুষ্কৃতীর সম্ভাব্য ভূমিকা, যদিও ইতিমধ্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস সচিব সেই আশঙ্কা ভিত্তিহীন বলেছেন। উত্তরে অবশ্য ভারত সরকার আরও জোরের সঙ্গে বিপদের আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। বাস্তবিক, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক পট পরিবর্তন ও মৌলবাদের নতুন স্ফুরণের পর থেকেই ভারত সরকার এক কঠিন সীমান্ত সমস্যার সম্মুখীন। এমনিতেই পশ্চিমের পাকিস্তান সীমান্তের চেয়ে পূর্বের বাংলাদেশ সীমান্ত অনেক বেশি জটিল ও বিপদবাহী, কেননা পূর্ব সীমান্ত এখনও অনেকটাই অরক্ষিত। সীমান্ত দিয়ে পারাপার ও চলাচল এখনও কিছুটা অনিয়ন্ত্রিত। এই সহজ-অতিক্রম্য ও সুদীর্ঘ সীমান্তপথ কেবল পশ্চিমবঙ্গের (ও অসমের) ক্ষেত্রেই নয়, স্বাধীনতার পর থেকে সমগ্র দেশের সুরক্ষার ক্ষেত্রে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। স্বভাবতই সম্প্রতি সেই চ্যালেঞ্জ বেড়ে গিয়েছে অনেক গুণ। জঙ্গি অনুপ্রবেশের সম্ভাবনা মাথায় রেখে কেন্দ্র ও রাজ্যের সরকারি স্তরে ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলির মধ্যে সমন্বয়ের প্রয়োজন আজ প্রশ্নাতীত। এই বিপদের মোকাবিলায় রাজনীতিরও সহযোগিতা দরকার। পশ্চিমবঙ্গের প্রধান বিরোধী দলের ফেক নিউজ় ও গুজবভিত্তিক স্থানীয় রাজনীতি রাজ্যের পক্ষে তথা দেশের পক্ষে কতখানি বিপজ্জনক হতে পারে, সহজেই বোধগম্য। বিপদের গুরুত্ব বুঝে আজ এই রাজ্যের সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের কর্তব্য— স্থানীয় রাজনীতির কুয়োর বাইরে বেরিয়ে আসা, এবং হাত মিলিয়ে রাজ্যের সঙ্কট সমাধানের প্রয়াস করা।

এই প্রসঙ্গে আর একটি বিষয় উল্লেখ্য। পশ্চিমবঙ্গ প্রায় ৩০ শতাংশের কাছাকাছি সংখ্যালঘু অধিবাসীর ভূমি। প্রায় সব ক’টি সীমান্তবর্তী জেলা মুসলিমপ্রধান। এমন এক সন্ধিক্ষণে এই রাজ্য ও দেশের পক্ষে বিপজ্জনক এমন কোনও রাজনীতি করা উচিত নয়, যা সেই সম্প্রদায়ের মানুষের পিঠকে দেওয়ালে ঠেকিয়ে দিতে পারে। এই রাজ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ মোটের উপর অক্ষুণ্ণ, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সংস্কৃতি এই বাংলার দীর্ঘ ঐতিহ্য। কোনও কারণেই উগ্র ধর্মীয় আবেগ এখানে তৈরি হতে দেওয়া যাবে না, কেননা তাতে সহজেই নানা দিক থেকে উস্কানি আসতে পারে। সুতরাং সব রকম বিদ্বেষমূলক প্ররোচনা, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা এখনই বন্ধ হোক। বরং পশ্চাৎপদ সংখ্যালঘু সমাজকে আরও বেশি করে মূলস্রোতে শামিল করার প্রয়াস হোক— শিক্ষা বা কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে। দেশের ও রাজ্যের এই গভীর সঙ্কটের সামনে যদি ধর্মবিদ্বেষের রাজনীতিতে রাশ না টানা হয়, নাগরিক সমাজ যদি সতর্ক না হয়, ইতিহাস এই সময়কে ক্ষমা করবে না।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Murshidabad WAQF Amendment Act

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy