Advertisement
০৭ মে ২০২৪
Sri Lanka Crisis

রাজনীতির ফাঁদ

পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে আন্তর্জাতিক মহল হাত না বাড়ালে শ্রীলঙ্কার বাঁচার কোনও আশা নেই।

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০২২ ০৬:০২
Share: Save:

২০০১ সালে যে বার শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক বৃদ্ধি মাইনাস ১.৪ হয়েছিল, তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী যা বলেছিলেন তার মর্মার্থ: সাগরে পেতেছি শয্যা। কঠিনতর সময়ে যে সেই শয্যাটুকুও ভেসে যেতে পারে, তার প্রমাণ সে দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সঙ্কট। তামিল ও সিংহল নববর্ষ আগতপ্রায়, অথচ খুচরো মুদি দোকানের ভাঁড়ার থেকে সুপার মার্কেটের তাক সবই খালি, পেট্রল পাম্পে দীর্ঘ লাইন। যেটুকু পণ্য এখনও বাজারে আছে তারও দাম আগুন, মাথাপিছু বরাদ্দও নির্দিষ্ট। রান্নার গ্যাস অমিল, বিদ্যুৎ বিভ্রাট চলছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ইতিহাস বলছে, এ-হেন সঙ্কট শ্রীলঙ্কায় অদৃষ্টপূর্ব, যুদ্ধের বিপদগ্রস্ত দিনগুলিতেও এমন অর্থনৈতিক বিপর্যয় এই দ্বীপরাষ্ট্রকে দেখতে হয়নি। এমতাবস্থায় রোজই রাজপথে নামছেন প্রতিবাদী নাগরিকেরা, প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের পদত্যাগের দাবি জোরালোতর হচ্ছে। পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে আন্তর্জাতিক মহল হাত না বাড়ালে শ্রীলঙ্কার বাঁচার কোনও আশা নেই।

সুতরাং গোড়ার প্রশ্নটিই করতে হয়: এমন বিপর্যয়ের কারণ কী? বলতেই হয়, নাগরিক দাবিতে অসঙ্গত কিছু নেই, মুখ্যত রাজাপক্ষে পরিবার-নিয়ন্ত্রিত প্রশাসনের অপরিণামদর্শিতার ফলেই শ্রীলঙ্কাবাসীর জীবনে ঘোর দুর্যোগ ঘনিয়ে এসেছে। সে দেশের আর্থিক সঙ্কট দ্বিমুখী— এক, সরকার বাজার থেকে এত বেশি ধার করেছে যে, নিয়মিত ঋণ শোধ অসম্ভব হয়ে উঠেছে; এবং দুই, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য খাতে বিপুল ঘাটতি। দ্বিতীয় সঙ্কটটি ২০১৯ ইস্টার সানডের বিস্ফোরণ এবং অতিমারিসঞ্জাত, যার ফলে আবার বিদেশি মুদ্রায় ঘাটতি পড়েছে। দক্ষ প্রশাসনের পক্ষে এই ধাক্কা সামলানো অসম্ভব ছিল না, কিন্তু রাজাপক্ষেরা এর পরেও অপ্রয়োজনীয় সব ভুল করে গিয়েছেন। যেমন, রাতারাতি সার রদ করে জৈব চাষের পন্থাবলম্বন অথবা রুপি-র পতন নিয়ন্ত্রণে বিদেশি মুদ্রা কাজে লাগানোর পাশাপাশি আমদানির উপর নিয়ন্ত্রণ জারি করা। ফলাফল, খাদ্যসঙ্কট ও মূল্যবৃদ্ধি। এমনকি, গত কয়েক মাস ধরে যখন বিদ্যুৎ ও অত্যাবশ্যক পণ্যের সঙ্কট চলছে, তখনও জেদ করে আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডারের শরণাপন্ন হননি শ্রীলঙ্কার শাসকবর্গ তথা রাজাপক্ষে পরিবার।

শ্রীলঙ্কার এই বিপদ থেকে শিক্ষা নেওয়ার আছে— ভ্রান্ত রাজনীতির বিপদ। রাজাপক্ষেদের রাজনীতির মূল পুঁজি উগ্র সিংহল বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদ, যেখানে সংখ্যালঘু তামিল ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণার চাষ হয়। এই শতকের প্রথম দশকে তামিল টাইগার জঙ্গিদের বিরুদ্ধে প্রবল সেনা আগ্রাসনই প্রধানমন্ত্রী মহিন্দা রাজাপক্ষের গদি পাকা করেছিল, এবং তাতে ভেসে গিয়েই তামিল অধিকার নিয়ে বার্তা দেওয়া ভারত ও পশ্চিমি দেশগুলির উপর নির্ভরতা ছেঁটে ফেলতে চেয়েছিলেন তিনি। অতএব চিনের সঙ্গে মিত্রতা— যে দেশ শ্রীলঙ্কার ‘সার্বভৌমত্ব’ নিয়ে প্রশ্ন তুলবে না। পূর্ববর্তী বাজারপন্থী ও উদারবাদী নীতি থেকে সরে আসার কারণও সেটিই। কিন্তু সরকারি ব্যয়ে বাণিজ্যিক ঋণের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা যখন শ্রীলঙ্কাকে ডুবিয়ে দিল, তখন মানবাধিকার ও অস্বচ্ছ প্রশাসনে কলঙ্কিত দেশকে রক্ষা করতে কেউই এগিয়ে এল না। উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ ও কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি কী ভাবে সুশাসনের পথে কাঁটা হতে পারে, এবং তাকে আর্থিক ভাবে পঙ্গু করে দিতে পারে, সেই শিক্ষা কি এ বার বিশ্ব গ্রহণ করবে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sri Lanka Crisis gotabaya rajapaksa
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE